আল-মামুন খান, কিশোরগঞ্জ : আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে বইছে মৃদু হাওয়া। এর অন্যতম কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে মৌসুমী প্রার্থীদের কিছুটা সরব প্রচারনা থাকলেও এবার তারা ফেইসবুক ও পোস্টারেই সীমাবদ্ধ। বিএনপিতে যারা হেভিয়েট সম্ভাব্য প্রার্থী কৌশলগত কারণে তারা মাঠের রাজনীতিতে নির্জীব। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভ্যান্তরিন দলীয় কোন্দলও এর অন্যতম কারণ। আসনটিতে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী মাঠে থাকলেও আওয়ামী লীগে রয়েছে ডজনখানেক সম্ভাব্য প্রার্থী। বিএনপিতেও রয়েছে একের অধিক প্রার্থী। তবে তারা এখনো মাঠে নামেনি, নেই তাদের তেমন কোনো কর্মকান্ড। কিন্তু নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান এমপির মতো শক্ত অবস্থান অনেকেরই নেই। এক সময়ে আসনটিকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলা হলেও এখন আওয়ামী লীগের অভ্যান্তরীন বিভাজন ও জাতীয় পার্টির টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার ফলে ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় আসনটি ব্যক্তি চুন্নুর দূর্গে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনটি জেলার করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ১টি পৌরসভা (করিমগঞ্জ পৌরসভা), ইউনিয়ন রয়েছে ১১টি। এখানে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮৮ এবং নারী ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৭০ জন। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৮ জন। এছাড়া তাড়াইল উপজেলায় রয়েছে ৭টি ইউনিয়ন। এখানে পুরুষ ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৬১ হাজার ৯৯৪ জন এবং নারীর ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৫৯ হাজার ৬৯২ জন। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬০৬ ভোট। সব মিলিয়ে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৪ জন।
জাতীয় পার্টি ॥ কিশোরগঞ্জ- ৩ আসনে বর্তমান সাংসদ জাতীয় পার্টির মহাসচিব এডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনী মহাজোট করে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আসন্ন নির্বাচনকে টার্গেট করে প্রতি মাসে ৩-৪ বার নিজ এলাকায় আসছেন তিনি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সরজমিনে খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চাইছেন তিনি। আসনটিতে বর্তমানে জাতীয় পার্টির একক শক্তিশালী প্রার্থী তিনি।
আওয়ামী লীগ ॥ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর করিমগঞ্জ-তাড়াইলে শুরু হয় বিভাজনের রাজনীতি। তাড়াইলে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক দ্বন্দ্ব আর করিমগঞ্জে অসাংগঠনিক ব্যক্তির হাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পড়ায় দলটি ক্রমশ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে মহাজোটের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়। ফলে দলটি টানা তিনবার আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত থাকে।
২০০৮ সালের পর করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ তিনভাগে ও তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভাজন হয়। করিমগঞ্জে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আমিরুল ইসলাম খান বাবলু আর অন্যদুটি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান ও আমেরিকা প্রবাসী কামরুল ইসলাম চৌধুরী মামুন দেখভাল করছেন। এদিকে করিমগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হাজী আব্দুল কাইয়ূম দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ উপজেলা আওয়ামী লীগকে সু-সংগঠিত করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের একটি অংশ সাংগঠনিক গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে মাঠে রয়েছেন কেন্দ্রীয় সেচ্ছাসেবক লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিষ্টার গোলাম কবির ভূইয়া। এদিকে তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগও মোতাহার-লাকী বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবী, আমাদের মধ্যে বিভাজন থাকলেও দলীয় মনোনয়ন প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি, তারা চায় যেকোনো মূল্যে আসনটি নিজেদের কবজায় আনতে। আসন্ন নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না।
আসনটিতে দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আমিরুল ইসলাম খান বাবলু, উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসিরুল ইসলাম খান, বাংলাদেশ মিলস্কেল রি-প্রসেস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা মো. এরশাদ উদ্দিন, প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আ ন ম নৌশাদ খান, করিমগঞ্জ পৌরসভার দুইবারের সাবেক মেয়র ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হাজী আব্দুল কাইয়ূম, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজুল হক হায়দার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, তেজগাঁও কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাক্তন এডিসি অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসিমুল হক, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক শামীম আহমেদ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার গোলাম কবির ভূঁইয়া মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ৮-১০ জন শুধু ফেসবুকে সরব। মাঠে তাঁদের তৎপরতা নেই।
বিএনপি ॥ এ আসনটি আবার ফিরে পেতে বিএনপি তাদের প্রকাশ্য কোনো কর্মকান্ড তেমন একটা না চালালেও দলের অভ্যন্তরে তাদের প্রস্তুতি চলছে। বিএনপির হাইকমান্ডের দাবি, আসনটিতে এই মূহূর্তে দলীয় সাংগঠনিক অবস্থা খুবই মজবুত ও সুদৃঢ়। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহন করবে না বলে সিনিয়র নেতারা জানান, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ববধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে আমরা ও আমাদের দলের সিদ্ধান্ত এক ও অভিন্ন। যদি ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে ভোটের সুষ্ট পরিবেশ তৈরি করে তবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলে জানায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ আসনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা প্রার্থী হয়েছিলেন। এছাড়াও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এডভোকেট জালাল মুহাম্মদ গাউস, জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ভিপি সাইফুল ইসলাম সুমন বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবে বলে জানা যায়। এদিকে উপজেলা বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। সাবেক এ মন্ত্রী যোদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন।
অন্যান্য ॥ বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে ডঃ এনামুল হক ইদ্রিছ, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে দিলোয়ার হোসাইন ভূইঁয়া, জেএসডি থেকে মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে মোঃ আলমগীর হোসাইন, জাসদ থেকে মোঃ শওকত আলী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জ জেলা নির্বাচন অফিসের ফল অনুযায়ী দেখা যায়, এই আসনটিতে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল কদ্দুছ মোক্তার নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাশেম চৌধুরীকে অল্প ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম এ গনি নির্বাচিত হন। এরপর এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের ৭ মে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে এডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগের আবুল হাশেম চৌধুরীকে হারিয়ে নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৯১ সালে ড. মিজানুল হককে দিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি থেকে কবির উদ্দিন আহম্মদ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে ড. মিজানুল হক আওয়ামী লীগ থেকে আবারও মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলীয় কোন্দলের কারণে পাঁচ শতাধীক ভোটের ব্যবধানে সাবেক সাংসদ ড. এম এ গনির সন্তান বিএনপির প্রার্থী ড. ওসমান ফারুকের কাছে পরাজিত হন। সেই থেকে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর টানা তিনবার জাতীয় পার্টি থেকে এডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু এ আসনে সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।