মোজাম্মেল আলম ভূঁইয়া, সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর : চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা সীমান্ত। এই উপজেলার লাউড়গড়, চাঁনপুর, টেকেরঘাট, বালিয়াঘাট, বীরেন্দ্র নগর ও চারাগাঁও সীমান্ত এলাকায় রয়েছে ১টি করে বিজিবির ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পের সোর্স পরিচয় দিয়ে কিছু সংখ্যক লোক চোরাচালানীদেরকে নিয়ে সীমান্ত এলাকায় তৈরি করেছে সিন্ডিকেড। তারা সরকারের লক্ষলক্ষ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে অবৈধ ভাবে প্রতিদিন মদ, গাঁজা, হেরুইন, ইয়াবা, কাঠ, কয়লা, পাথর, ঘোড়া, গরু, চাল, বিড়ি ও অস্ত্র পাচাঁর করে। পরে পাচাঁরকৃত অবৈধ মালামাল থেকে পুলিশ, বিজিবি ও সাংবাদিকসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম ভাংগিয়ে সোর্সরা বিভিন্ন হারে চাঁদা উত্তোলন করে।
চোরাচালান ও চাঁদাবাজি করে সীমান্ত এলাকার অনেক সোর্স হয়েগেছে জিরো থেকে হিরো। তবে সোর্সের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা, মদ, কয়লা ও অস্ত্রসহ চাঁদাবাজি মামলা। বিভিন্ন সময় সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে আংশিক অবৈধ মালামাল পরিত্যক্ত অবস্থায় আটক করা হয়। কিন্তু সোর্স পরিচয়ধারীদেরকে কখনোই গ্রেফতার করা হয়না। যার ফলে সোর্সরা সীমান্ত এলাকায় সারাবছর নিরাপদে দাপটের সাথে তাদের চোরাচালান বাণিজ্য জমজামাট ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়- প্রতিদিনের মতো গতকাল বুধবার (১৬ জুন) রাত ১২টায় উপজেলার বালিয়াঘাট সীমান্তের লালঘাট এলাকা দিয়ে সোর্স পরিচয়ধারী ইয়াবা কালাম মিয়া ও চোরাচালানী খোকন মিয়া ভারত থেকে মদ, কাঠ ও বরশির চিপ পাচাঁর করে। পরে সেই অবৈধ মালামাল সোর্স ইয়াবা কালামের বাড়ির সামনে অবস্থিত সমসার হাওরের পাড়ে রাখা ইঞ্জিনের নৌকায় বোঝাই করার সময় বিজিবি অভিযান চালিয়ে ১.৫ ঘনফুট কাঠ ও ৩হাজার পিচ ভারতীয় বরশির চিপ জব্দ করে। কিন্তু সোর্স কালাম, চোরাচালানী খোকন মিয়াসহ তাদের নৌকা আটক করেনি।
এঘটনার পর রাত অনুমান ১টার সময় পাশর্^বর্তী চারাগাঁও সীমান্তের বাঁশতলা তেতুলগাছ, লালঘাট ও এলসি পয়েন্ট এলাকা দিয়ে পৃথক ভাবে সোর্স পরিচয়ধারী শফিকুল ইসলাম ভৈরব, বাবুল মিয়া ও রমজান মিয়া ভারত থেকে চাল, কয়লা ও মদ পাচাঁর করে। পরে পাচাঁরকৃত অবৈধ মালামাল চোরাচালানী খোকন মিয়ার ইঞ্জিনের নৌকায় বোঝাই করে সমসার হাওর দিয়ে পাটলাই নদীপথে নেত্রকোনা জেলার কমলাকান্দা নিয়ে যায়। কিন্তু এব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে এর আগে জংগলবাড়ি নামকস্থান থেকে ৩০হাজার টাকা মূল্যের ২০ বোতল ভারতীয় মদ জব্দ করেছে বিজিবি। কিন্তু মদের মালিক সোর্স পরিচয়ধারী লেংড়া জামালকে গ্রেফতার করা হয়নি।
এছাড়া টেকেরঘাট সীমান্তের লাকমা, টেকেরঘাট, বুরুঙ্গাছড়া, বড়ছড়া ও রজনীলাইন এলাকা দিয়ে সোর্স পরিচয়ধারী লেংড়া বাবুল, জিয়াউর রহমান জিয়া, কামাল মিয়া ও ইসাক মিয়া, চাঁনপুর সীমান্তের নয়াছড়া, চানপুর, রাজাই, কড়াইগড়া, বারেকটিলা এলাকা দিয়ে সোর্স রফিকুল ইসলাম, আবু বক্কর ও আলমগীরসহ লাউড়গড় সীমান্তের যাদুকাটা নদী, শাহ-আরোফিন মোকাম, সাহিদাবাদ ও পুরান লাউড় এলাকা দিয়ে সোর্স পরিচয়ধারী নুরু মিয়া, জজ মিয়া, নবীকুল, শহিদ মিয়া, এরশাদ মিয়া, আমিনুল মিয়াগং প্রতিদিন ভারত থেকে বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, গরু, ঘোড়া, পাথর, কয়লা, কাঠ, বিড়ি ও তক্ষক পাচাঁর করছে। উপরের উল্লেখিত সোর্সদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মদ, বিড়ি, কয়লা ও অস্ত্র পাচাঁরসহ চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে।
এব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে- সুনামগঞ্জ ২৮ ব্যাটালিয়নের সাবেক বিজিবি অধিনায়ক মাকসুদুল আলম প্রায় ৬বছর সুনামগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। তিনি যোগদানের প্রথম দিকে তাহিরপুর সীমান্ত চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য ভাল ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি পাল্টে যান। বাড়তে থাকে সোর্সদের সংখ্যা ও সীমান্ত চোরাচালান। আর সেই সীমান্ত চোরাচালান নিয়ে সংবাদ প্রকাশের কারণে মিথ্যা মামলা দিয়ে তিনি হয়রানী করেন অনেক সাংবাদিককে। কিন্তু সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদরের সীমান্ত এলাকার এক নিরীহ কৃষকের গৃহপালিত গরুকে ভারতীয় চোরাই বলে বিজিবি আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইলে তার প্রতিবাদ করায় গুলি করে হত্যা করে ওই কৃষককে। এঘটনার প্রেক্ষিতে মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে বির্তকিত বিজিবি অধিনায়ক মাকসুদুল আলমকে অন্যত্র বদলি করে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। পরে তার স্থলে এসে যোগদান করেন বর্তমান বিজিবি অধিনায়ক তসলিম এসহান। তিনি যোগদানের পর সীমান্ত এলাকার চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য শুরু করেন নতুন অভিযান। সেই অভিযানের কারণে মহাবিপদে পড়ে যায় সোর্স ও চোরাকারবারীরা। কিন্তু তাদের অবৈধ কাজ বন্ধ করেনি। তাই সীমান্ত চোরাচালান চিরতরে প্রতিরোধ করতে সোর্স পরিচয়ধারীদের শীগ্রই গ্রেফতারের জন্য সুনামগঞ্জ বিজিবি অধিনায়কসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন সীমান্ত এলাকার সর্বস্তরের সচেতন জনসাধারণ।
এব্যাপারে চারাগাঁও ক্যাম্পের সোর্স পরিচয়ধারী শফিকুল ইসলাম ভৈরব বলেন- এলাকার মানুষ ভারত থেকে কয়লা ও চালসহ বিভিন্ন মালামাল এনে সংসার চালায়। এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করলে কিছুই হবেনা। গত কয়েকদিন আগে সোর্স কালাম মিয়া ও খোকন মিয়াকে নিয়ে আমরা কয়লা নিয়েছি। আমাদের কোন সমস্যা হয়নি। কারণ আমাদের সাথেও সাংবাদিক আছে। কোন সমস্যা হলে তারা সবাইকে ম্যানেজ করবে। লাউড়গড় সীমান্তের সোর্স এরশাদ মিয়া বলেন- বিজিবি আমাকে ভাল জানে তাই ডেকে তাদের সাথে নিয়ে যায়। তবে এখন আর তেমন কিছু হয়না। শুধু ঠেলাগাড়ি দিয়ে পাথর আনে এলাকার গরীব মানুষ।
এব্যাপারে সুনামগঞ্জ ২৮ ব্যাটালিয়নের বিজিবি অধিনায়ক তসলিম এহসান সাংবাদিকদের বলেন- জব্দকৃত অবৈধ মালামাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে জমা দেওয়া হবে। সীমান্ত চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।