যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নেপথ্যে কি আছে
কিন্তু কেন? যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী কারণে ইজরায়েলকে অন্য সব দেশের চেয়ে আলাদা নজরে দেখে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েল কখন ও কীভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠল- সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান : আমেরিকার ইসরাইলের প্রতি সমর্থনের মূল কারণ খুব সম্ভবত এর ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান সম্প্রদায়। ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় হলো আমেরিকার সবচেয়ে বড় একক ধর্মীয় গোষ্ঠী যারা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ এবং মূলত দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বাস করে।
ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের ইজরাইলের কট্টর সমর্থক হওয়ার কারণ তারা মনে করে ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের পুনরাগমন হবে না। মুসলিমদের মত এরাও যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসী। যীশু খ্রীষ্ট নাকি পুনরায় পৃথিবীতে এসে আরমাগেডনের যুদ্ধে শয়তানকে পরাজিত করবে এবং ইহুদিরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে। এরপর এক হাজার বছর পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। এই বিশ্বাসের কারণে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানেরা সবসময়ই ইসরাইলে ইহুদি বসতি স্থাপনের কট্টর সমর্থক এবং লবিং এর মাধ্যমে আমেরিকার রাজনীতিবিদদের উপর চাপ সৃষ্টি করে ইজরায়েলকে সমর্থন যোগানোর।
ইজরায়েল পন্থী লবিং : ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন ইজরাইলপন্থী ইহুদি লবিং গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে আমেরিকার ইসরাইলপন্থী নীতি গ্রহণের জন্য। ইজরাইল পন্থী লবিং গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল American_Israel_Public... বা সংক্ষেপে
আইপ্যাক যারা মূলত সিনেটর প্রার্থীদের রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে অর্থের যোগানের মাধ্যমে তাদের ইসরাইলকে সমর্থন জোগাতে বাধ্য করে। আইপ্যাক সরাসরি সিনেটরদের টাকা দেয় না তারা বরং ইসরাইলপন্থী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির মাধ্যমে কংগ্রেসের সদস্য হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের টাকা দেয় এই শর্তে যে তাদের ইসরাইলপন্থী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করে বলা যাক, প্রতিবছর আইপ্যাকের বার্ষিক নীতিমালা নির্ধারণী কনফারেন্স যে হল রুমে বসে তার পাশের রুম গুলোতেই ধনাঢ্য দাতা এবং আইপ্যাক সমর্থিত নির্বাচনী প্রার্থীদের ডেকে আনা হয় কথা বলার জন্য। পাশের রুম গুলোর কার্যকলাপ সরাসরি আইপ্যাকের নামে পরিচালিত হয় না, সুতরাং এভাবে ইসরাইলপন্থী কংগ্রেস প্রার্থীদের অর্থের যোগান দেওয়াতে আইপ্যাকের ঘাড়ে দোষ পরে না।আইপ্যাকের কংগ্রেসের উপর এতটাই প্রভাব যে এই ওপেন সিক্রেট নিয়ে কথা বলাও এক রকমের অপরাধ। এই বছরের শুরুর দিকে সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন রিপ্রেজেন্টিভ ওমর ইলহান আইপ্যাকের লবিং নিয়ে কথা বললে তাকে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে হয়। তাকে ঢালাওভাবে "ইহুদি বিদ্বেষী" তকমা দেওয়া হয় এবং কংগ্রেসে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। যেভাবে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান উভয় পক্ষের কংগ্রেসম্যানেরাই তার পিছনে উঠে পড়ে লেগেছিল তাতেই প্রমাণিত আমেরিকার সিনেটে ইসরাইলি লবিং এর প্রভাব কতটা বেশি।
ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং: ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং ইসরাইলের সাইবার নিরাপত্তা প্রদানকারী সংস্থা ইউনিট ৮২০০ হল বিশ্বসেরা যাদের সাথে কাজ করে আমেরিকা উপকৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমেরিকায় সক্রিয় থাকা এক হিজবুল্লাহ সদস্যকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোসাদের আমেরিকার সিআইএ'র সাথে ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং। এমনকি টুইন টাওয়ারে হামলার পূর্বাভাসও নাকি মোসাদ দিতে সক্ষম হয়েছিল। আর Operation_Diamond এর কথা তো না বললেই নয় যেখানে ইজরাইলের মোসাদ ইরাকি বিমান বাহিনী হতে একটি মিগ-২১ চুরি করে এনে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়। ইসরাইল এবং আমেরিকা এই প্লেনের খুঁটিনাটি জেনে নেয়। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমেরিকা ইসরাইলকে নিজের তৈরি এফ আর ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।
সাইবার ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কথা বললে বলা যায় আমেরিকার সাইবার ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করা এনএসএ এবং ইজরাইলের ইউনিট ৮২০০ মিলে Stuxnet নামে একটি ম্যালওয়ার তৈরি করে ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের গতি শ্লথ করে দিতে। ইউনিট ৮২০০ তে কাজ করা অনেক যুবকই পরে সিলিকন ভ্যালিতে বিভিন্ন নামিদামি আইটি কোম্পানি খুলেছে (এমনকি আপনার ভাইবারও তাদের তৈরি) এটাও আমেরিকার ইজরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটি বড় কারণ।
আমেরিকার অস্ত্র পরীক্ষাগার : ইজরাইল আমেরিকার তৈরি অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা পারফর্ম করবে তা পরীক্ষা করে দেওয়ার সুযোগ করে দেয় বিশেষ করে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের বিরুদ্ধে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরাইল ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। মিশর, লেবানন, সিরিয়ার সাথে ইজরাইলের সামরিক সংঘাত লেগেই থাকত যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতো। মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রদের ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি আমেরিকায় প্রস্তুতকৃত অস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রকে কতটা কাউন্টার দিতে পারবে তা পরীক্ষা করার বড় সুযোগ ইজরাইল এনে দিয়েছিল।
ইসরাইলি প্রযুক্তি : আমেরিকা তার উন্নয়নের জন্য ইসরাইলি টেকনোলজির উপর নির্ভর করে। মাইক্রোসফট, আইবিএম, ইন্টেলের প্রধান প্রধান অনেক রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ইজরাইলে রয়েছে। ইন্টেলের মাইক্রোপ্রসেসর উন্নয়নে ইজরায়েলি বিজ্ঞানীদের অসাধারণ অবদান রয়েছে। একটি মরুভূমি প্রধান দেশ হিসেবে ইজরাইল যেভাবে ড্রিপ সেচ, পানিকে আর্সেনিক এবং লবণমুক্ত করা সহ আরো বিভিন্ন টেকনোলজি আবিষ্কার করেছে তা আমেরিকা তার টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়ার মত মরু প্রধান উত্তপ্ত অঞ্চলগুলোতে কাজে লাগায়। ব্রাইটসোর্স ইন্ডাস্ট্রিস নামে একটি আমেরিকান কোম্পানি ইসরাইলি টেকনোলজি ব্যবহার করে সোলার প্যানেল তৈরি করছে যা আমেরিকার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ করে দিবে।
গণতন্ত্র : শুধু ইসরাইলপন্থী আমেরিকানদের নয় অন্যান্য গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্য দেশের নাগরিকদেরও বলতে শুনেছি ইসরাইল হল আরব দেশের শরিয়া আইন দ্বারা বেষ্টিত (যা তাদের দৃষ্টিতে খারাপ), সন্ত্রাসী কবলিত অঞ্চলে একমাত্র গণতন্ত্র এবং শান্তির দিশারী। ইসরাইল ঠিক আমেরিকার মতোই জুডিও-ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধের উপর গড়ে উঠেছে। একই সাথে এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশও বটে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো হয় স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা অর্ধ গণতান্ত্রিক দেশ। ইজরায়েল পন্থী আমেরিকানদের অনেককেই ইসরাইলকে সমর্থন করার কারণ হিসেবে এই ব্যাপারটি উল্লেখ করতে দেখেছি তবে আমেরিকার রাষ্ট্র নীতিতে এর প্রভাব কতটা আমার জানা নেই কারণ আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে নিজ স্বার্থে অনেক রাজতন্ত্র, স্বৈরশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে।
আমেরিকান ইহুদি গোষ্ঠী : এটা কারোরই অজানা নয় যে ইহুদীরা সংখ্যায় খুব কম হওয়া সত্বেও অত্যন্ত ধনী এবং মেধাবী। বিশ্ব জনসংখ্যার দশমিক ২ শতাংশ হওয়া সত্বেও নোবেল পুরস্কারের ২০ শতাংশই পেয়েছে ইহুদিরা। আমেরিকার ৪০০ বিলিয়নিয়ারের ৩৫% বিলিনিয়রই ইহুদি যদিও তারা সংখ্যায় আমেরিকার জনসংখ্যার দুই শতাংশেরও কম। অবশ্য বর্তমানের মার্কিনী ইহুদিরা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় আমেরিকার ওপর খুব চাপ প্রয়োগ করছে কিনা তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। আমেরিকার ইহুদিদের সিংহভাগই ডেমোক্রেটকে ভোট দেয় যারা রিপাবলিকানদের তুলনায় তুলনামূলক কম ইসরাইলপন্থী। পিউ রিসার্চ অনুযায়ী আমেরিকান ইহুদিদের ৪০ শতাংশের মত মনে করে ইসরাইল প্যালেস্টাইনে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করছে। নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের মধ্যে তীব্র ইজরাইলপ্রেম তুলনামূলক কম দেখা যায়। তবে এটা ধরে নেওয়া রিস্কি কিছু নয় যে আমেরিকার প্রভাবশালী ইহুদি সম্প্রদায় আমেরিকার ইসরাইলকে সমর্থন যোগানোর একটি মূল কারণ।
মুসলিম বিদ্বেষ : এসকল কারণ ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার মাথায় আসছে তা হল মার্কিনীদের ইসলাম বিদ্বেষ। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু বলে তো একটা কথা আছে, বিভিন্ন উগ্রপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠী যেমন আইএস, তালেবান, আল-কায়েদার কারণে মুসলিমদের সম্পর্কে আমেরিকায় খুবই নেতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান। যেহেতু ইসরাইল মুসলিমদের একটি শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় তাই সাধারণভাবেই আমেরিকার জনসাধারণ ইজরায়েলের পক্ষালম্বন করে।
মোদ্দা
কথা বলতে গেলে আমেরিকা ইসরাইলের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ হওয়ার
কারণ সেই অঞ্চলের জিওপলিটিক্স। ইসরাইল প্যালেস্টাইন সংকটের কারণে খুব দ্রুতই ইজরায়েলের আমেরিকার প্রভাব বলয় হতে বেরিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই, আর এই সমস্যার
সমাধান হলেও যে দুই দেশের
সম্পর্কে খুব একটা পরিবর্তন আসবে তা আমি মনে
করি না। কারণ হিসেবে বলবো উভয় দেশের কমন মূল্যবোধ এবং প্রযুক্তি নির্ভরতা যেখানে আরবদেশগুলো রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল এবং আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার ক্ষেত্রে অনেকটাই নিজেদের তৈল সম্পদের উপর নির্ভরশীল যার কোনটাই স্থায়ী নয়। তবে আমেরিকার ইসরাইলকে চির সমর্থন যোগানোর কারণ হিসেবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানেরা এবং আইপ্যাকের লবিংই মূল ভূমিকা পালন করছে।
তথ্য সূত্র:
ইন্টারনেট
লেখক ,
তৌফিক আহম্মেদ (তাপস)
এম,এস,এস (অর্থনীতি)