সালমান ফার্সী, (সজল) নওগাঁ : নওগাঁর পত্নীতলায় কেঁচো সার তৈরী, বসতবাড়িতে সবজি চাষ ও মুরগি পালন করে বিকল্প আয়ের মাধ্যমে পরিবার বাড়তি আয় করছেন সমাজে পিছিয়ে পরা কয়েকশ’ পরিবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা। আয়ের পাশাপাশি বাড়ির পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা মেটাচ্ছেন। আগামীতে আরো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সরকারি এবং বে-সরকারি ভাবে এগিয়ে নিতে প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সুবিধা দিতে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী নওগাঁ জেলায় ২৮হাজার ৩শ’ ৯৭ পরিবারে ১লাখ ১৬ হাজার ৭শ’ ৩৬ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাস। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের মতে জেলায় প্রায় ২লাখ ৫০হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাসবাস করেন। এ সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে উরাও, পাহান, সান্তাল, রাজোয়ার, ভুঁইয়া, মাহাতো, তুরি, মাহালি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নওগাঁ জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শতকরা ৯৮ভাগই কৃষিমজুর। কৃষি বহির্ভূত কাজে তাদের দক্ষতা না থাকা এবং বছরের অর্ধেক সময় মাঠে কৃষি কাজ না থাকায় এ সময়গুলোতে তাদের চরম কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। এ সময় তাঁরা আগাম শ্রম বিক্রয়, সুদের উপর টাকা নিয়ে, ধার দেনা করে এবং অর্ধাহারে থেকে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়।
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অচল হয়ে পড়ে পত্নীতলায় বসবাসরত প্রায় ৩৫হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জীবন। অব্যাহত লক ডাউনের কবলে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তাঁরা। ঘরের খাবার না থাকা এবং হাতে কোন কাজ না থাকায় চরম সংকটে পড়ে যায় এই সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। আয় উপার্জনের কোন পথ না থাকায় অনেকেই মানেবেতর জীবনযাপন করেন। করোনা কালীন প্রভাব মোকাবিলার মাধ্যমে যাতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো জীবণের চাকা সচল রাখতে পারে সে লক্ষ্যে বরেন্দ্রভূমি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (বিএসডিও) দাতা সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন "ডিগনিটি এন্ড লিডারশীপ ডেভেলপমেন্ট অব ইথনিক মাইনোরিটি" প্রকল্পের আওতায় কেঁচো সার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, মুরগী পালন এবং বাড়ির ছাদে ও খোলা জায়গায় সবজি চাষের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান অব্যাগত রাখে। এ সকল বিকল্প আয় বৃদ্ধিমুলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা পরিবারে বাড়তি আয়ের যোগান দিচ্ছে।
সরেজমিনে উপজেলার পতœীতলা ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীদের কর্মব্যস্থতা। ওই গ্রামের রায়মুনি পাহান নামে এক নারী কেঁচো সারের পরিচর্যা করছেন। তিনি জানান, গত প্রায় ১বছরে তিনি ৮মণ কেঁচো সার তৈরী করেছেন। ৭মণ সার তিনি জমিতে ব্যবহার করেছেন এবং ৫শ’ ৪০ টাকায় ১মণ সার বিক্রয় করেছেন। ১হাজার ২শ’ ৮০ টাকায় তিনি ৮শ’ গ্রাম কেঁচো বিক্রয় করেছেন।
শ্যামলি পাহান জানান, বাড়ির কাজের পাশাপাশি একটু সময় দিয়ে গত কয়েক মাসে তিনি ৪শ’ ৫০ টাকায় ১মণ সার বিক্রয় করেছেন এবং ১হাজার ৬শ’ টাকায় ১ কেজি কেঁচো বিক্রয় করেছেন। শুধু তাঁরাই নয়, বিএসডিও’র সহযোগিতায় উপজেলা কৃষি বিভাগ হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের ১৩জন নারী পরিবেশ বান্ধব কেঁচো সার তৈরী ও বিক্রয় করে বাড়তি উপার্জন করছেন। বাড়তি আয়ের যোগান দেওয়ার পরিবারে তাঁদের গুরুত্ব বেড়েছে। এই সার তৈরীতে বাড়তি কোন খরচ ও সময় লাগে না বলেও জানান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই নারীরা।
সবজি বাগান পরিচর্যার সময় কথা হয় সুমতি উরাও এর সাথে। তিনি জানান, বিএসডিও হতে বীজ পেয়ে তিনি বাড়ির সামনের পতিত জমিতে লাল শাক, পালংক শাক, ধনিয়া, কপি, রসুন, টমেটো লাগিয়েছেন। এই সবজি ক্ষেতে তিনি কেঁচো সার ব্যবহার করেছেন। উৎপাদিত সবজি নিজেরা খাচ্ছেন এবং বাজারে বিক্রয় করে বাড়তি আয় করছেন। সবজির পাশাপাশি অনেকেই বিএসডিও’র সহায়তায় দেশী জাতের মুরগী লালন পালন করে লাভবান হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
পতœীতলা ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ইছাহাক হোসেন বলেন, বিএসডিও’র মাধ্যমে তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের কেঁচো সার তৈরী ও বসত বাড়িতে সবজি চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। পরিবেশ বান্ধব কেঁচো সার জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। রাসায়নিক সারের চেয়ে কেঁচো সার সাশ্রয়ী। এটা মানুষের স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি করে না। জমির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পর পর একটি জমিতে ৩বার কেঁচো সার ব্যবহার করলে পরবর্তিতে আর সার প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। পরিবেশ সুরক্ষায় বিএসডিও’র এ ধরণের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান এই কর্মকতা।
বিএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রউফ জানান, কর্মএলাকা পতœীতলা ও মহাদেবপুরে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবন মানের পরিবর্তনে বিএসডিও নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি কাজে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দক্ষতার বিয়টি বিবেচনায় নিয়েই তাদের জন্য কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কর্মসূচীর মুল্যায়নের মাধ্যমে পরবর্তিতে কর্মকান্ডের পরিসর বাড়ানো হবে। বর্তমানে কর্মএলাকায় ২শ’ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার কেঁচো সার তৈরী, ১শ’ ৪৭টি পরিবার মুরগী পালন এবং ১শ’ ৫০টি পরিবার বসত বাড়ির আঙিনা ও উঠানে সবজি চাষ করে পরিবারে বাড়তি আয়ের যোগান দিচ্ছে বলেও তিনি জানান।