নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি: অনিয়ন্ত্রিত ও অমানবিকভাবে চড়া সুদের ব্যবসা বন্ধের দাবিতে নওগাঁয় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শনিবার দুপুরে নওগাঁ সচেতন তরুণ প্রজন্মের ব্যানারে জেলা শহরের মুক্তির মোড় প্রাঙ্গণে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ও অমানবিকভাবে চড়া সুদের ব্যবসা নওগাঁতে ভয়াভব রূপ ধারণ করেছে। চড়া সুদ বা দাদন ব্যবসার ফাঁদে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। সুদের টাকা শোধ করতে না পেরে বহু মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। বর্তমানে চড়া সুদের ব্যবসা সমাজে নিরব ব্যধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। অসহায় মানুষের অভাবের সুযোগ নিয়ে সুদের টাকা গ্রহণকারী ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ফাঁকা চেকের বিপরীতে টাকা ঋণ দিচ্ছে দাদন ব্যবসায়ীরা। শুধু দাদন ব্যবসায়ীরা নয়, সমবায় সমিতির নামে অনেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে চড়া সুদের ব্যবসা করছে।
তাঁরা বলেন, ২০-৩০ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে ফাঁকা চেকে নিজের ইচ্ছে মতো টাকার অংক বসিয়ে লাখ লাখ টাকা দাবি করছে দাদন ব্যবসায়ীরা। অনিয়ন্ত্রিত ও অমানবিকভাবে চলা চড়া সুদের এই ব্যবসাবন্ধ করতে করতে না পারলে সমাজ ও দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে অতি দ্রুত প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তাঁরা।
নওগাঁ সচেতন তরুণ প্রজন্মের আহ্বায়ক শফিকুর রহমান মামুনের সভাপতিত্বে মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেন, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক ও সংস্কৃতি কর্মী জহুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নওগাঁ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার দেব, নওগাঁ সচেতন তরুণ প্রজন্মের সদস্য সচিব আমানুজ্জামান শিউল প্রমুখ।
জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক শফিকুর রহমান বলেন, নওগাঁ জেলার সর্বস্তরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চড়া সুদের ব্যবসা বিস্তার লাভ ঘটেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত দুইভাবে এই সুদ ব্যবসা চলছে। নিবন্ধিত অধিকাংশ সমবায় সমিতি আইন বর্হিভূতভাবে ফাঁকা চেকের বিপরীতে সদস্যদের মাঝে ঋণ বিতরণ করছে। আবার অনেকে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রাতিষ্ঠিানিক ভিত্তি ছাড়াই বার্ষিক, মাসিক, এমনকি সাপ্তাহিক বিভিন্ন মেয়াদে সুদের ব্যবসা করছে। এটি সমাজে দাদন ব্যবসা নামে পরিচিত। এরা ব্যাংকের চেকের বিপরীতে সুদে টাকা দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের এই দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
জহুরুল ইসলাম বলেন, দাদন ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছে মতো সুদ ধার্য করে চড়া সুদে ব্যবসা করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যাংকের ফাঁকা চেক ও জমির দলিলের বিপরীতে সুদের টাকা দিচ্ছে তাঁরা। প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে জেলায় অন্তত ৩০০ দাদন ব্যবসায়ী ও নিবন্ধিত প্রায় দেড়শ সমবায় সমিতি প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে তাঁদের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে সমাজবিরোধী এই কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে। ইতোমধ্যে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আর যেন কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে না পড়ে এর আগেই এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দাদন ব্যবসায়ীদের গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেকটা ইউনিয়ন ও উপজেলায় সুনির্দিষ্টভাবে দাদন ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা পরিষদ কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি, কোনো দাদন ব্যবসায়ী কিংবা মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সুদ ব্যবসা করার প্রমাণ পেলে তাঁদের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে আমার শতভাগ সমর্থন থাকবে।’
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত জেলা সমবায় কর্মকর্তা হোসেন শহীদ বলেন, ‘কোনো সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে আইন বিরোধীভাবে সুদ ব্যবসা পরিচালনার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেক্ষেত্রে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ সুদে টাকা লাগালে কিংবা সুদ ব্যবসা পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রে আমরা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো না। এক্ষেত্রে প্রতারিত ব্যক্তিকে থানা কিংবা উপজেলা প্রশাসনে অভিযোগ করতে হবে।’
জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের অডিট ও আইন বিভাগের প্রধান উপ-নিবন্ধক সেলিমুল আলম শাহিন বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কোনো সমবায় প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ হারে বার্ষিক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। ফাঁকা চেকের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার কোনো আইনি বৈধতা নেই। কোনো সমবয় সমিতির দ্বারা এভাবে কেউ প্রতারিত হলে সুনিদির্ষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করলে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক হারুনু-উর-রশীদ বলেন, কমবেশি নওগাঁর প্রায় সবখানেই দাদন ব্যবসা রয়েছে। এ ব্যাপারে লোকজনকে সচেতন হতে হবে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে। ফাঁকা চেক কিংবা জমির দলিলের বিনিময়ে কোনো ব্যক্তি প্রতারিত হলে এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দাদন ব্যবসায়ীদের কোনো ধরণের প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।