আজ ভয়াল ১৩ সেপ্টেম্বর, সাপাহারকে মুক্ত করতে ২১ বীর মুক্তিসেনা প্রান বিসর্জন দিয়েছিল
নয়ন বাবু, সাপাহার (নওগাঁ) প্রতিনিধি: স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর আবারো ফিরে এলো সেই ভয়াল ১৩ সেপ্টেম্বর। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের কাঁদাতে ও ১৯৭১ এর ১৩ সেপ্টম্বরের সেই বিভৎস রুপ স্মরন করে দিতে। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি সস্ত্র দল জেলার সাপাহারবাসীকে শত্রæ মুক্ত করতে গিয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং সে যুদ্ধে ২১জন বীর সেনা হাসিমুখে তাদের তাজা প্রান বিসর্জন দিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অনেকেই। তাই ১৩ সেপ্টেম্বর সাপাহারবাসীর জন্য ইতিহাসে ভয়াল দিন হিসেবে আজও পরিচিত। প্রতিবছর এই দিনটি স্মরন করে অনেক সন্তান হারা মা, ভাই হারা বোন ও তাদের আত্মীয় স্বজনরা অঝোর ধারায় তাদের চোখের পানি ফেলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে দিনের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম জাহিদুল ইসলাম, মনছুর আলী, আঃ রাজ্জাক সহ একাধীক মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকার কিছু প্রবীন ব্যক্তিদের নিকট থেকে অনুসন্ধান করে জানা যায়, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সাপাহার সদরের পূর্বদিকে একটি পুকুর পাড় ও পাড় সংলগ্ন স্কুলে (বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এখান থেকেই তারা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অসহায় মা-বোনদের সম্ভ্রমহানী নিরহী লোকদের ব্রাশফায়ার ও বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগ করে থাকত। দেশের এই প্রতিকূল অবস্থায় বর্বর হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সাপাহারবাসীকে মুক্ত করার জন্য সাপাহার ও মহাদেবপুর এলাকার ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকহানাদার বাহিনীর লেঃ শওকত আলীর অধীন সাপাহারের ওই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে উৎখাত করার জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমন চালানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই দিন রাতে মুক্তিযোদ্ধা মেজর রাজবীর সিং এর আদেশক্রমে ও ইপিআর হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহর নেতেৃত্বে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধার সংঘটিত দলটিকে ৩টি উপদলে বিভক্ত করে একটি দলকে সাপাহার-পতœীতলা রাস্তার মধইল ব্রিজে মাইন বসানোর কাজে নিয়োজিত করা হয়, যাতে পতœীতলা হতে শত্রæ সেনারা সাপাহারে প্রবেশ করতে না পারে। অন্য একটি দলকে নিয়োজিত করা হয় সার্বক্ষনিক টহল কাজে। আর মূল দলটি অবস্থান নেয় শত্রæ শিবিরের একেবারে কাছাকাছি একটি ধানক্ষেতে। কিন্তু হাজারো সর্তকতার জাল ভেদ করে মোনাফেক রাজাকার আলবদর মারফত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের খবর পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে। তাৎক্ষনিক ভাবে পাকসেনারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। চলতে থাকে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের নানা পরিকল্পনা। অবশেষে শেষ রাতের দিকে ধানক্ষেতে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার সাথে সাথে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুুল লড়াই। লড়ায়ের একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার দলটি যখন শত্রæ সেনাদের প্রায় কোন ঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক এমনি অবস্থায় ভোরের আভাস পেয়ে ব্রীজে মাইন বসানোর দলটি সেখান থেকে সরে পড়লে তার কিছুক্ষন পরই পতœীতলা হতে অসংখ্য শত্রæ সেনা আরোও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে। এর পর শত্রæপক্ষের অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মুখে হিমশিম খেয়ে এক সময় বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এ সময় শত্রæপক্ষের গুলির আঘাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদসহ ১৫ জন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরন করেন। আহত হন মনছুর আলী, এসএম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহমদ উল্লাহ, সোহরাব আলী, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে। এছাড়া শত্রæদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। শত্রæরা আটক ৮ জনের মধ্যে ৪ জনকে পতœীতলার মধইল স্কুলের ছাদে তুলে কুপিয়ে হত্য করে লাশগুলি লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। ২ জন কে ধরে এনে মহাদেবপুরের একটি কূপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয় এবং সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের ও মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর গ্রামের মৃত এসএম আবেদ আলীর পুত্র টকবগে যুবক এসএম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোরের রাজবাড়ীতে তৈরীকৃত জেলখানায় বন্দি করে রাখে।
শত্রæ সেনার বন্দিদশা ও সেই ভয়াল ১৩ সেপ্টেম্বর এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জেল ফেরত যুদ্ধাহত জাহিদুল ইসলাম হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন এবং অশ্রæসিক্ত নয়নে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন আস্থানা গোপন তথ্য ও অস্ত্র ভান্ডারের খবর জানার জন্য প্রতিদিন সকালে তাদের দু’জনকে হানাদার বাহিনীর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট উপস্থিত করা হত। তথ্য আদায়ে ব্যার্থ হলে কর্মকর্তার সামনেই ধারালো অস্ত্র (চাকু) দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে লবন মাখিয়ে দেয়া হতো। অসহ্য যন্ত্রনায় অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন ছটফট করতো শত্রæবাহিনীর সকলেই তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। এমনি হাজারো দুঃখ কষ্টের মাঝে থেকে সুযোগ বুঝে একদিন তারা জেলের প্রাচীর টপকে পালিয়ে এসে প্রানে বাঁচেন।
এ বিষয়ে সাপাহার উপজেলার সদ্য সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলহাজ্ব ওমর আলী জানান, ২১ বীর সেনার স্বরনে আগামীকাল মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে স্বরন সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।