প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর মাদকের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযানে নেমেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব সদর দফতর জানিয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযানে গত এক মাসে (৪ মে-৩১ মে ১৮) র্যাব মোট ৮৩৭ টি অভিযান পরিচালনা করে। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয় ৪২৯টি। এসময় মোট ৪ হাজার ৬শ ৪৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ৩১ জন মাদক ব্যবসায়ী।
র্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, মাসব্যাপী ৮৩৭টি অভিযানে গ্রেফতার হয় ১০২৬ জন। উদ্ধার করা হয় ৩ কেজি ৬শ ৫৯ গ্রাম হেরোইন, ৮ হাজার ৮১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৭ হাজার ১৪৬ বোতল ফেন্সিডিল, ৫২৮ কেজি গাঁজা, ২ হাজার ১৬৮ বোতল বিদেশি মদ ও ১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৫১ লিটার দেশি মদ। উদ্ধারকৃত এসব মাদকদ্রব্যের বাজার মূল্য ৬২ কোটি টাকা।
মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে গত এক মাসে র্যাব ৪২৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৩ হাজার ৬শ ১৯ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৫৩ জনকে সর্বোচ্চ দুই বছর থেকে সর্বনিম্ন ৭ দিনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। যাদের ৫৬৬ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং ৩ হাজার ৫৩ জন মাদকসেবী। এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালত আটককৃতদের ১ কোটি ২৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা জরিমানা করে।
র্যাব পরিচালিত অভিযানে নিহত ৩১ মাদক ব্যবসায়ী : গত ৪ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে ৩১ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে বলে দাবি র্যাবের। গত ১৫ মে নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রিপন, কুষ্টিয়ায় র্যাব-১২ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হামিদুল ইসলাম, ১৭ মে রাজশাহী র্যাব-৫ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবুল হাসান ওরফে হাসান নামে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
১৮ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জে র্যাব-৫ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আব্দুল আলিম, চট্টগ্রাম সদর থানা এলাকায় র্যাব-৭ এর সঙ্গে হাবিবুর রহমান প্রকাশ ওরফে মোটা হাবিব এবং মো. মোশাররফ নিহত হন। গত ১৯ মে যশোরের অভয় নগরে র্যাব-৬ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবুল কালাম ও হাবিব শেখ ও মিলন কাশারী নামে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
গত ২১ মে টাঙ্গাইলে র্যাব-১২ এর সঙ্গে আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহীতে র্যাব-৫ এর সঙ্গে লিয়াকত আলী মন্ডল, ঝিনাইদহে র্যাব-৬ এর সঙ্গে ছব্দুল মন্ডল, নরসিংদীতে র্যাব-১১ এর সঙ্গে ইমান আলী নামে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
২২ মে চট্টগ্রামে শুক্কুর আলী, ফেনীতে মো. মঞ্জুরুল আলম, বাহ্মণবাড়ীয়ায় ধন মিয়া, নারায়ণগঞ্জ বাচ্চু মিয়া, ২৩ মে গাইবান্ধায় রাজু, ফেনীতে মো. ফারুক ২৫ মে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কামরুল, ২৬ মে দিনাজপুরে সাবদারুল, জয়পুরহাটে রেন্টু শেখ ২৭ মে টেকনাফে একরামুল হক (পৌর কাউন্সিলর), ২৮ মে নাটোরে খালেক (৩৫), ২৯ মে বরগুনায় ফিরোজ মৃধা, ৩০ মে কক্সবাজারে মজিবুর রহমান (৪২), ৩০ মে চট্টগ্রামে ইসহাক ওরফে ইয়াবা ইসহাক (৩৫), সিরাজগঞ্জে আশান হাবীব (৪৫), ভাষানটেকে আতাউর রহমান ওরফে আতা, বাপ্পি (৩৮) ও মোস্তফা হাওলাদার ওরফে কসাই মোস্তফা (৫০) নামে মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
এদিকে অব্যাহত মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়ার ঘটনা, নিরপরাধীদেরও আটক ও কারাদণ্ড দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকা কমিশন ও টিআইবি।
যদিও শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তা ব্যক্তির বলছেন, ‘কাউকে হত্যা করা হচ্ছে না, যা ঘটছে বন্দুকযুদ্ধ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’
৩১ মে (বৃহস্পতিবার) টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সংবিধান সব নাগরিককে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। কথিত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা তালিকা ধরে মাদকবিরোধী যে অভিযান চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা আইনগতভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যেভাবে ‘তালিকা’ ভুক্তরা নিহত হচ্ছেন, তা পুরোপুরি অসাংবিধানিক।
ক্ষেত্র বিশেষে অনেকেই প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মাঠপর্যায়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ও সেবনকারী চুনোপুঁটিরাই ‘বন্দুকযুদ্ধে’র শিকার হচ্ছেন। মাদক সমস্যার স্থায়ী সমাধানে যারা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা হতে পারতেন। ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা নস্যাৎ হচ্ছে, অন্যদিকে মাদক ব্যবসার মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের দেশের বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থা অনুসরণ করে বিশেষ করে মাদক সরবরাহ চেইনের রুই-কাতলাদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে, আইনকে পাশ কাটিয়ে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি যেভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’
মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কার্যকর পন্থা নয়। অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। নিয়ম মেনে সবার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।’
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানে কোনো নিরপরাধ মানুষকে আমরা ধরছি না। কোনো ক্রসফায়ার হচ্ছে না। কোনো নিরপরাধীকে নয় শুধু তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরছে।’