অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী : মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের প্রদান করেছেন যথার্থ পথনির্দেশ। তাকে কখনোই থাকতে হয় নি দিশেহারা হয়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আমি প্রতিটি জাতির জন্যই রাসুল প্রেরণ করেছি।’ [আল কুরআন] মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতরণের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বারা মানব জাতিকে প্রদান করা হয় পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা। তাদের জন্য করণীয়-বর্জনীয় সব কিছুর স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে তাতে। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা। তাই সৃষ্টির মন্দ এবং ভালো সম্পর্কে তিনিই সর্বাধিক পরিজ্ঞাত। সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর বিষয়কে তিনি বৈধ করেছেন আর অকল্যাণকর বিষয়কে করেছেন অবৈধ।
হারাম ইসলামি শরিয়তের একটি পরিচিত পরিভাষা। অর্থ অবৈধ, নিষিদ্ধ, অননুমোদিত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় যে সকল বিষয়ের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অকাট্য দলিল রয়েছে তাকে হারাম বলে। প্রতিটি ক্রিয়ারই কোনো না কোনো প্রতিক্রিয়া রয়েছে। হারামও এর ব্যতিক্রম নয়। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে হারামের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। মন্দ খাদ্য খেলে শরীরে যেমন মন্দ প্রভাব দেখা যায়, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে হারামেরও তেমন মন্দ প্রভাব রয়েছে।
সাধারণত মানুষ যে সব হারামে লিপ্ত হয় তা হলো, খাদ্য গ্রহণ, উপার্জন ও হারাম কাজ সম্পাদন। হারাম খাদ্য গ্রহণের দ্বারা মানব মনে সৎ কাজের ইচ্ছা হ্রাস পায় এমন পাপ কাজের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। ইসলামী চিন্তক মুহিতুল ইসলাম সিদ্দিকী আদিল বলতেন, আমি একবার এক দাওয়াতে গেলাম। আর আগে থেকে আমার জানা ছিলো না যে, ঐ ব্যক্তির উপার্জন হারাম। না জানার কারণে এই ভেবে চলে গিয়ে ছিলাম যে, সে তো একজন মুসলিম। সুতরাং তার উপার্জন হালাল হবে এটাই স্বাভাবিক। কিছু খানা খেয়েও ফেললাম। এক পর্যায়ে জানতে পারলাম, তার উপার্জন হারাম। তখন সাথে সাথে খানা ছেড়ে উঠে গেলাম। কিন্তু ঐ যে না জেনে কয়েক লোকমা খেয়েছিলাম, তার মন্দ প্রভাব কয়েক মাস পর্যন্ত অনুভব করলাম। আর তাহলো, বারবার মনে গুনাহর ইচ্ছা জাগতো যে, অমুক গুনাহ করি, অমুক গুনাহ করি।
হারাম কাজ করার দ্বারা ব্যক্তির লজ্জাশীলতা হ্রাস পায়। মন থেকে আল্লাহ ভীতি কমে যায়। সমাজে অনিষ্টের সৃষ্টি হয়। পরকালীন শাস্তির উপযুক্ত হতে হয়। মানব জীবনে হারামের যে সব দিক রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো হারাম উপার্জন। ব্যক্তি যদি হারাম উপার্জন করে তাহলে সে স্বাভাবিকভাবেই হারাম আহার করে। হারাম পরিধান করে। আর এ সম্পর্কে ইসলামে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। হারাম কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর বিরুদ্ধাচারণ করা হয়। কেননা কুরআন ও হাদিসে হালাল ও হারামকে পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কারণে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হালাল উপার্জন করা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট এ দুটির মাঝে সন্দেহযুক্ত বিষয় আছে অনেক লোক তা জানে না। যে সন্দেহযুক্ত জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে তার দিন এবং সম্মানকে ত্রুটি মুক্ত রাখলো। আর যে সন্দেহযুক্ত জিনিষের মধ্যে পতিত হলো সে হারামের মধ্যে পতিত হলো।
যদি কেউ এ সম্পর্কে না জানে তাহলে তার জ্ঞানীদের নিকট থেকে জেনে আমল করা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জানো।’ [সূরা নাহল:৪৩] হারাম খাদ্য দ্বারা গড়া শরীর কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে হারাম অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধক।
এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোজখের আগুনই উত্তম। [জামিউস সগির: ৮৬৪৮] হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ কবুল করেন না। অনেকে হারাম সম্পদ উপার্জন করে পাপমোচনের আশায় দান খয়রাত করে থাকেন। হারাম উপার্জনের দানে সাওয়াব হওয়া তো দূরের কথা এ দান আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলূল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের দানও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না।’ [ইবনে খুজাইমাহ: ১০] হারাম উপার্জনের দ্বারা সমাজে জুলুম অত্যাচারের দ্বারা উন্মোচিত হয়। যেমন ঘুষ নেয়া হারাম। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে সৃষ্টির উপর জুলুম করা হয়। ঘুষের সম্পদের যে গোস্ত হয় তার ঠিকানা জাহান্নাম, এ সম্পর্কে হযরত আবু বকর (রা.) এর ঘটনা ইমাম বুখারি (রহ.) মানাকেব অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর একজন ক্রীতদাস ছিলো যে তার ট্যাক্স আদায় করতো, হযরত আবু বকর (রা.) ট্যাক্সের পয়সায় তার সংসার চলতো, সে একদিন তার জন্য একটা জিনিস আনলো। হযরত আবু বকর (রা.) তার থেকে খেলেন। ক্রীতদাসটি তাকে বললো এটা কি তা আপনি জানেন? তিনি প্রশ্ন করলেন এটা কি? সে বললো- আমি ইসলাম পূর্বযুগে এক ব্যক্তির রাশিফল গণনা করেছিলাম। আর এ রাশিফল গণনা করতে আমি তার সাথে ধোঁকাবাজী করতাম। তার সাথে আজ আমার সাক্ষাৎ হওয়ার পর সে আমাকে ঐ জিনিস দিয়েছিলো। তার থেকেই আপনি খেয়েছেন, হযরত আবু বকর (রা.) মুখের ভেতর হাত দিলেন এবং পেটের ভেতর যা ছিলো সব বমি করে দিলেন।
হযরত কা’ব বিন উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘হে কা’ব বিন উজরা! আমি আল্লাহ তার নিকট তোমার জন্য ঐ সমস্ত শাসক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যারা আমার পরে আসবে। যে ব্যক্তি তাদের দরবারে যাবে তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করবে। তাদের অত্যাচারে সাহায্যে করবে সে আমার সাথে নয়। আমিও তার সাথে নই। সে হাউজে আসতে পারবে না। আর তাদের দরবারে গেলো অথবা না গেলো, তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করলো না, তাদের অত্যাচারে সাহায্যে করলো না। সে আমার সাথে আমিও তার সাথে এবং সে হাউজের কাছে আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে। হে কা’ব ইবনে উজরা নামাজ হলো দলিল-প্রমাণ। সিয়াম হলো শক্ত ঢাল। দান সদকা গুনাহকে তেমনই মিটিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে মিটিয়ে দেয়। হে কা’ব ইবনে উজরা! ঐ মাংস বৃদ্ধি পায় না যা হারাম দ্বারা তৈরি হয়। বরং জাহান্নাম এর থেকে উত্তম।’ বর্তমানে হারাম উপার্জনের আরেকটি মাধ্যমে হলো সুদ। ইসলামে এটি একটি জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কারভাবে সুদকে হারাম করেছেন। সুদ না ছাড়লে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কথা বলেছেন। হাদিসে রাসুল (সা.) সুদ গ্রহণ করাকে নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার থেকেও নিকৃষ্ট বলেছেন।
সুদ এমন এক হারাম যা সমাজের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। অভাবীকে আরো অভাবী করে। আর ধনীকে করে আরও ধনী। এর মাধ্যমে এক শ্রেণির লোক নির্বিচারে শোষিত হয় আরেক শ্রেণির লোক বিনা পরিশ্রমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। হারাম উপার্জনের দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে অতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। দিন দিন তার মাঝে সম্পদের চাহিদা বাড়তে থাকে। আমরা দেখতে পাই, যে ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে লোভ লালসা তার মনের মধ্যে অনেক বেশি বাসা বাঁধে। সে মনে কখনো শান্তি পায় না। সব সময় কৃপণতা করে। তাদের হাত ভর্তি কিন্তু মন খালি। মানুষ তাদের সম্পর্কে বলে, ধনীরা গরিবদের সম্পদের প্রতি বেশি লোভাতু হয়। কেননা হাদিসের ভাষায় তারা হলো এমন যে, খাবার গ্রহণ করে তবে তাদের পেট ভরে না। আর যে সুদের কারবারের মধ্যে পড়ে যায়, সে তার থেকে তওবা করে না। ফলে সুদ গ্রহণ করা থেকে তার মধ্যে অনুশোচনা আসে না। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, অন্যায় কাজ তার জন্য সুন্দর করে দেখানো হয়। সে নিজে সেটিকে ভালো মনে করে। ফলে কোনো বাহানা বা ষড়যন্ত্র করতে ত্রুটি করে না। আমরা দেখতে পাই তাদেরকে যারা মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অথবা শুনতে পাই তাদে সম্পর্কে যারা কোনো কাজ করে দিয়ে তার পরিবর্তে ঘুষ নেয় অথবা জমির দালালি করে পয়সা নেয় তাদের এই হারাম উপায়ে অর্জন করতে অন্তর কাঁপে না। তারা মানুষের ন্যায্য অধিকার দিতে কার্পণ্য করে শ্রমিকের মজুরি ঠিকমতো দেয় না। আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ পথে কখনোই শান্তি, নিরাপত্তা মিলতে পারে না। পরকালীন এবং ইহকালীন উভয় জীবনেই হারাম ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। সবশেষে সেই দোয়া করি যা রাসুল (সা.) করেছেন- ‘হে আল্লাহ! হারাম থেকে বাঁচিয়ে হালাল আমাদের জন্য যথেষ্ট করে দিন। গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে আনুগত্য যথেষ্ট করে দিন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের মুখাপেক্ষীহীন করে দিন।
লেখক : অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী, ইসলামী চিন্তক ও শিক্ষা-সংগঠক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন