তৌফিক তাপস : আজ ৩০জুন ২০২০ পালিত হবে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৬ বছর।অতীতকাল থেকেই সাঁওতালরা অবিভক্ত ভারতের আদি বাসিন্দা হিসেবে খ্যাত।বাংলাদেশের রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলে সাঁওতালরা বসবাস করে।সাঁওতালদের গায়ের রং কালো,নাক চ্যাপ্টা,ঠোঁট মোটা,চুল কোঁকড়ানো এবং দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের।
বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট:
১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার অনগ্রসর সাঁওতালদের পৃথকভাবে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেয়,যা তৎকালে "দামিন-ই-কোহ" (দুমকা)নামে পরিচিত ছিল।পরবর্তীতে এটি "সাঁওতাল পরগনা" নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।সেই প্রতিশ্রুতিতে সাঁওতাল আদিবাসীরা বন-জঙ্গল কেটে বসবাসের উপযোগী ও আবাদযোগ্য করে তোলে।নিজেদের উৎপাদিত ফসলে তাদের জীবন-জীবিকা ভালোই কাটছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত কালাকানুন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দুরাবস্থার জন্য হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের চক্রবৃদ্ধি সুদ,দাদন ইত্যাদি ব্যবসায়ের ফলে সরল প্রকৃতির সাঁওতালরা এর খপ্পরে পরে সর্বস্বান্ত হতে থাকে।নিম্ন আয়ের সাঁওতালগণ দৈনিক পরিশ্রম করে যা পেতো,তা মহাজনের ঋণের খাতায় জমা হতো।কিন্তু মহাজনের চক্রান্তে ঋণ কখনোই শেষ হতো না।ঋণের দায় মেটাতে শেষ পর্যন্ত সাঁওতালদের ক্রীতদাসের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়।এ ধরনের অমানবিক নিষ্পেষণের ফলে সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে থাকে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ:৩০জুন ১৮৫৫ সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব এবং তাদের দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানু মুর্মুর আহ্বানে ৪০০ গ্রামের ১০,০০০ সাঁওতাল নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে,যা ইতিহাসে "সাঁওতাল বিদ্রোহ " নামে খ্যাত।ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের এ বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার এক বিরাট বাহিনী নামায়।এতে বহু সাঁওতাল মারা যায়। প্রায় দেড় বছর যুদ্ধ শেষে সাঁওতালরা পরাজিত হয়।সাঁওতালদের ভাষায় এ বিদ্রোহকে বলা হয় "হুল" যার অর্থ স্বাধীনতা যুদ্ধ। মূলত এটি ছিল আধুনিক অস্ত্র বনাম তীর-ধনুকের যুদ্ধ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ,১৮৯৯-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহ,তেভাগা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ,১৮৫৯-১৮৬২ নীল চাষিদের বিদ্রোহ,১৮৭২ সালের রায়ত অভ্যুল্থান,১৮৭৫
-৭৬ সালের দাক্ষিণাত্যের মারাঠা কৃষকদের অভ্যুল্থানসহ ইতিহাসের অনেক কৃষক আন্দোলন সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে প্রেরণা পেয়েছে।
তেমন কর্মসূচি নেই-
দিনটি ঘিরে প্রতিবছর সিধু, কানু, চাঁদ ও ভাইরবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ, দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সাঁওতাল বিদ্রোহে আত্মদানকারীদের। উদযাপন করে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। এ ছাড়া জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদ, আদিবাসী নারী পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, আদিবাসী মুক্তি মোর্চা, নাচোল আদিবাসী একাডেমি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), নওগাঁ জেলা শাখা বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাটের বিভিন্ন স্থানে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস পালন করে থাকে। তবে এ বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে তেমন কর্মসূচি নেওয়া হয়নি।
তৌফিক আহম্মেদ তাপস
এমএসএস (অর্থনীতি)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন