সার্বিক পরিস্থিতি
তৌফিক আহম্মেদ (তাপস) :
২৩ এপ্রিল, ২০২১। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ান নিখোঁজ সাবমেরিন কেআরআই নানগালা ৪০২ (KRI Nanggala 402) এর ৫৩ জন ক্রুকে উদ্ধার করতে বাকি রয়েছে কয়েক ঘন্টার সময়। ঘটনার শুরু গত ২১ এপ্রিল, বুধবারে। স্থানীয় সময় রাত ৩টার দিকে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীর সাবমেরিন কেআরআই নানগালা ৪০২ এর সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় কমান্ড সেন্টার। তার ঠিক কিছুক্ষণ পূর্বেই সাবমেরিনটিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল অতল সাগরে ডুব দেওয়ার।
★নানগালা ৪০২ এর পরিচয়
>মূলত একটি নৌ-মহড়াতে অংশ নিচ্ছিল ইন্দোনেশিয়া নৌবাহিনীর নানগালা ৪০২ সাবমেরিন। এটির লক্ষ্য ছিল লাইভ টর্পেডো ফায়ারিং অনুশীলন সফল ভাবে সম্পন্ন করার। সেই লক্ষ্যেই বেলা ৩টার সময় ডুব দেয় সাবমেরিনটি। এরপরেই নিয়মিত যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। সাবমেরিনটির অতীতে তাকালেই বোঝা যাবে যে এটি বেশ পুরোনো একটি সাবমেরিন। তৎকালীন পূর্ব জার্মানির কিয়েল এ Howaldt Deutsche Werke শিপইয়ার্ডের অধীনে ১৯৭৭-৮১ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এই সাবমেরিনটি। এটি একটি টাইপ ২০৯ সাবমেরিন। ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীতে এটি কমিশন পায় একই বছর, ১৯৮১ সালে। অর্থাৎ ২০২১ সালে এর বয়স দাঁড়িয়েছে ৪০ বছর। যা সাবমেরিনের হিসাবে একটু বেশিই বলা চলে। যদিও ২০০৯ হতে ২০১২ সাল অবধি দক্ষিণ কোরিয়ার অধীনে এই জাহাজটিকে আপগ্রেড ও রিফিট (Upgrade and Refit) করা হয়েছে। সেসময় সাবমেরিনের অনেক অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন করা হয়।
★দূর্ঘটনা
>সাবমেরিনটি শেষবার সমুদ্রে ডাইভ দিয়েছিল জাভা হতে ৯৬ কিলোমিটার উত্তরে। আপাতত সেই অঞ্চলটিই প্রাথমিক উদ্ধার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। ডাইভ লোকেশনের আশে পাশের সাগরে তেল লিক হওয়ার চিহ্নও পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনী প্রধান দুটি সম্ভাবনার কথা বলেন। এক, কোন দুর্ঘটনায় সাবমেরিনটির তেল রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দুই, সাবমেরিনাররা ইচ্ছাকৃত ভাবে তেল লিক করছে, যা সাবমেরিনটিকে ভাসিয়ে রাখার একটি ক্ষীণ চেষ্টা ও উদ্ধারকারী দলকে সংকেত দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে পরীলক্ষিত হচ্ছে।
★বিধ্বস্ত সাবমেরিনের সম্ভাব্য অবস্থা
>ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীর মতে সাবমেরিনটি খুব সম্ভবত ৬০০-৭০০ মিটার গভীরতায় অবস্থান করছে। কিন্তু এই সাবমেরিনটির অপারেটিং ডেপথ মাত্র ২০০-২৫০ মিটার। অর্থাৎ এটি স্বাভাবিক অবস্থায় সর্বোচ্চ ২০০-২৫০ মিটার গভীরতায় যেতে সক্ষম। অপারেটিং ডেপথ ২০০-২৫০ মিটার হলে মোটা দাগের হিসাবে এর ক্রাশ ডেপথ ধরা যায় ৪০০-৫০০ মিটার। অর্থাৎ এই গভীরতা অবধি সাবমেরিনটি কোন ভাবে টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু ৬০০-৭০০ মিটার গভীরে সাবমেরিনটির হাল (মূল কাঠামো) কতক্ষণ পানির চাপ সহ্য করতে পারবে বা আদৌ পারবে কি না সেটিই এক জ্বলন্ত প্রশ্ন। এছাড়াও একটি বিধ্বস্ত সাবমেরিনের ভেতরকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বিধ্বস্ত সাবমেরিনে অবধারিত ভাবে ব্ল্যাকআউট পরিস্থিতি থাকে। কিন্তু সাবমেরিনের অধিকাংশ কার্যক্রম বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় সাবমেরিন ক্রুরা এখন নিতান্তই অসহায়। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হল মারাত্নক অক্সিজেন স্বল্পতা। কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী সাবমেরিনটিতে সর্বোচ্চ ২৩ এপ্রিল রাত ৩টা (২৪ এপ্রিল, শনিবার) পর্যন্ত বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন রয়েছে। এর বেশি দেরি হলে মৃত্যু অবধারিত। এছাড়াও তাপ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া চালু না থাকায় তাপমাত্রা কত তা বলা যাচ্ছে না। প্রচন্ড ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
★আদৌ কি উদ্ধার করা সম্ভব?
>দুঃখজনক ভাবে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীর ৫টি সাবমেরিনের বহর থাকলেও তাদের কোন সাবমেরিন উদ্ধারকারী জাহাজ নেই। সাবমেরিন উদ্ধারের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া তাদের সর্বাত্নক সহোযোগিতার আশ্বাস দিয়ে একটি বিশেষায়িত উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে ও আন্ডার ওয়াটার সার্চ এন্ড ফাইন্ডিং এ পারদর্শী দুটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। আজ ২৩ই এপ্রিল বিশ্বমোড়ল আমেরিকাও সাহায্যস্বরুপ ঘটনাস্থলে বিমান পাঠিয়েছে। (সম্ভবত সাবমেরিন হান্টার পি-০৮ পোসেইডন এই দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছে। কারণ সাধারণ বিমানের খুব একটা কার্যকারিতা এ পরিস্থিতে নেই) কিন্তু ওই অঞ্চলের সাগরতল ঠিক সমান নয়। উচু নিচু সাগরতলের কোন খাদের আড়ালে সাবমেরিনটির অবস্থান হলে তা খুজে পাওয়া যাব কিনা তাই সন্দেহ।
অস্ট্রেলিয়ান দলের মধ্যে আছেন ‘সাবমেরিন ইন্সটিটিউ অফ অস্ট্রেলিয়া’ এর সচিব ফ্র্যাঙ্ক ওয়েন। প্রাক্তন সাবমেরিনার ও অস্ট্রেলিয় উদ্ধারকারী সংস্থার নির্মাতা ওয়েন বলেন, “বেশিরভাগ উদ্ধারকারী ব্যবস্থাই সর্বোচ্চ ৬০০ মিটার গভীরতায় কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। এর বেশি গভীরতায় হয়তো এসব যান যেতে পারে। কিন্তু উদ্ধারকারী অন্যান্য যন্ত্রাংশের পক্ষে এত গভীরে সচল হওয়া সম্ভব নয়। ফলে ঐ গভীরতায় পৌছাতে পারলেও উদ্ধার করা সম্ভব নয়।“
এছাড়াও উদ্বেগের ব্যাপার হলো নানগালা ৪০২ এ ‘রেসকিউ সিট’ ফিট করা নেই। সাবমেরিনের ক্রু উদ্ধার করার সময় উদ্ধারকারী যান সাবমেরিনের হ্যাচের ওপরে বসে একটি পানিরোধী পথ তৈরি করে। এরপর সেই পথ দিয়ে ক্রুরা উদ্ধারকারী যানে চলে আসেন। কিন্তু আলচ্য সাবমেরিনটিতে হ্যাচের পাশে কোন রেসকিউ সিট নেই। তাই উদ্ধারের সময় উদ্ধারকারী যান কতটুকু সফল হতে পারবে তাও একটি প্রশ্ন। কারণ এত গভীরতায় হিসাবে সামান্য ভুল হলেই উদ্ধারকারীরও সলিল সমাধি হবে।
★হ্যাচ খুলে সাবমেরিনাররা বের হয়ে আসছেন না কেন?
>এটি একটি অবাস্তব কিন্তু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন। তাই লেখাতে এর উত্তরও সংযুক্ত করছি। প্রথমত, সাবমেরিনের হ্যাচ কোন সাধারণ দরজা নয় যে এটি চাইলেই খোলা যাবে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত এই হ্যাচ খুলতে সাবমেরিনের মূল ব্যাটারি হতে শক্তি প্রয়োজন। দুর্ঘটনায় হ্যাচ কোনভাবে জ্যাম হয়ে গেলে মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম, শুধু শারীরিক শক্তি দিয়ে হাতির পক্ষেও হ্যাচ খোলা সম্ভব নয়। যদিও হ্যাচের জন্য রিজার্ভ পাওয়ার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ৭০০ মিটার গভীরতায় হ্যাচ খুললে সাবমেরিন আরো বিধ্বস্ত হওয়া বাদে আর কিছু হবে না। কারণ এই গভীরতায় পানির চাপে সাবমেরিনের হাল বেকে যায়। মানুষের পক্ষে এই চাপ সহ্য করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
★শেষকথা
>যদিও পরিস্থিতি খুবই আশংকাজনক তবুও আশা রাখতে বাধা নেই। আশা করি ৬টি দেশের সম্মিলিত উদ্ধার কার্যক্রম সফল হবে। ইতোমধ্যে সাগরপৃষ্ঠ হতে মাত্র ১০০-২০০ মিটার গভীরতায় প্রচন্ড চৌম্বক শক্তি সম্বলিত একটি বস্তুর নিশানা মিলেছে। যদি ৭০০ মিটারের ধারণা ভুল প্রমাণ করে এটিই সেই সাবমেরিন হয় তাহলে উদ্ধারকাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। আশা করি কেআরআই নানগালা ৪০২ এর ৫৩জন সাবমেরিনারই সুস্থ ভাবে তাদের পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও চিনের তৈরি টাইপ ০৩৫ (ন্যাটো কোডঃ মিং ক্লাস) সাবমেরিন ব্যবহার করছে। টাইপ ০৩৫ এর জি ক্লাস ভার্সনের সাবমেরিনগুলো ১৯৮৯ হতে ১৯৯৯ সালের মাঝে তৈরি হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে এই ক্লাসের দুটি সাবমেরিন বিএনএস জয়যাত্রা ও বিএনএস নবযাত্রা ২০১৭ সালে কমিশন লাভ করে। এ দুটি সাবমেরিন এখনো সফল ভাবে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে বর্তমানে বাংলাদেশেরও কোন সাবমেরিন রেসকেইউ প্ল্যাটফর্ম নেই।
লেখাঃ তৌফিক আহম্মেদ (তাপস)
এম,এস,এস (অর্থনীতি)
তথ্যসূত্রঃ গার্ডিয়ান, বিবিসি, রয়টার্স, ইউএসএনআই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন