নিজস্ব প্রতিবেদক : কমানো হয়েছে ঋণের সুদহার। দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও। পাশাপাশি রয়েছে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণের চাপ। এতে করে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ভিন্ন কথা। বাড়েনি বেসরকারি খাতের ঋণ, উল্টো কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা। নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না উদ্যোক্তারা। সংকটজনক পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন অনেকেই। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে যে হারে ঋণ পরিশোধ হয়েছে সেই হারে ঋণ বিতরণ হয়নি। সবমিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এই অঙ্ক গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
তবে পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। গত জুন মাসে ঋণস্থিতি ছিল ১০ লাখ ৯৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। জুলাইতে তা নেমে এসেছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২০১ কোটি টাকায়। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণ কমেছে ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা বা দশমিক ১৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মহামারির কারণে রফতানি কমে গেছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদাও কম। সবমিলিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আসছেন না। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন। এসব কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমেছে। যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার মানে, কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এটি প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও সেবা খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে বেসরকারি ঋণ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই যেকোনো প্রক্রিয়ায় ঋণ বাড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে রফতানি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প ও উৎপাদনমুখী খাতকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ পাশাপাশি সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানো ও বিদেশি উৎস থেকে কম সুদে ঋণ আনার পরামর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর।
এদিকে করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সরকারের নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগের বছরের মতো অপরিবর্তিত রেখে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সরকার থেকে নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন বিনিয়োগ জোরদারে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি কমে হয় ১৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর পরের ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ব্যাপকহারে কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশে। এরপর টানা তিন অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়ে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ; ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়ে হয় ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ; আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেটি আবার বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ দাঁড়ায়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু তা অর্জন হয় মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন