হাওর-বাঁওড় পেরিয়ে বিথঙ্গল ও দিল্লির আখড়া

হাওর-বাঁওড় পেরিয়ে বিথঙ্গল ও দিল্লির আখড়া!

বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী: ঝুমুর দেব দিদির নিমন্ত্রণে ঢাকার সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে রাত সাড়ে ১১টার বাসে চারজনের (ফারুখ আহমেদ, সুমন বসাক, হাদিরাতুল ও আমি) ছোট্ট একটি দল রওনা হলাম হবিগঞ্জের মিরপুরের উদ্দেশ্যে। গাড়ি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাতের নীরবতাকে ভেদ করে লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে রাত প্রায় ২টার দিকে শায়েস্তাগঞ্জে পৌঁছল। মাঝরাতে বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোকানে চা, বিস্কুট খেয়ে ঘুম তাড়িয়ে অটোরিকশায় চেপে ঘণ্টাখানেকের মাঝে হবিগঞ্জের মিরপুর স্ট্যান্ডে চলে এলাম। ঝুমুর দিকে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তার বাসায়। বেশ সাজানো গোছানো বাসায় পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে সবাই কিছুটা গা এলিয়ে দিলাম। দিদি তার মায়াবতী হাতের ছোঁয়ায় দারুণ সব নাস্তা বানিয়ে নিয়ে হাজির হলেন। অমৃতসম ঝিনুক পিঠা, তালের পিঠা, ডালের পিঠা, দধি ও মুরগি ভুনার স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে।

খুব সকালে মিরপুর থেকে অটোরিকশায় চেপে সবাই রওনা হলাম হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কালাডুবা নামক জায়গার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে খোয়াই নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ থেমে নদী তীরবর্তী জীবনযাপন, হাঁসের দলের সাঁতার ও সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। কালাডুবায় পৌঁছে হাওরের পাশেই ‘মায়ের দোয়া’ নামক দোকানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও চা পান করতে করতে আগে থেকে ঠিক করে রাখা বজরা ঘাটে ভিড়ল।

বজরায় উঠে সবাই বসামাত্রই মাঝি ইঞ্জিন চালু করে দিলো। কালাডুবা হাওরের জল কেটে লাল-সাদা শাপলা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের মাঝ দিয়ে বজরা যাত্রা শুরু করল। তখন মাথার উপর বিশাল আকাশে নীল-সাদা মেঘের খেলা, এর মাঝ দিয়েই সোনালি আলোর বিচ্ছুরণ ও মৃদু ঠান্ডা বাতাস শরীরে অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছিল। দূরে তাকাতেই দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি, হিজল, করচ গাছগুলো আপনমনে ডাকছিল।

ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে বজরা একসময় বিরতি নিল পলি পড়ে গড়ে ওঠা ঢিবির পাশে। আমি, সুমন দা, ঝুমুরদি ও হাদিরাতুল বজরা থেকে নেমে কাঁদা মাটিতে বাচ্চাদের সাথে খেললাম। কাঁকড়া ও এর বাসস্থান দেখলাম। বাচ্চাদের ভেলায় চড়ে জলে ভাসলাম। ওদিকে ফারুখ ভাই তখন একের পর এক সাটার টিপে অসাধারণ দৃশ্যগুলো স্মৃতিবন্দি করতে ব্যস্ত।

এরমাঝে সুমন দা বায়না ধরে বসল যে, সে এই ঢিবি ছেড়ে যাবে না। এখানেই দিনের বাকি সময়টা ছবি এঁকে কাটিয়ে দেবে। শেষে তাকে অনেক বুঝিয়ে যাত্রা শুরু করলাম বিথঙ্গল হাওরের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতেই পরিষ্কার সবুজ জলে পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, ছোট মাছের লাফালাফি ও এদের পিঠে আলোর ঝলক দেখে মুগ্ধ হলাম। ঝুমুর দিদি বাসা থেকে বড় এক টিফিনবাক্স ভরে পায়েস, দধি ও পিঠা এনেছিলেন। ছইয়ের নিচে বসে ঢেউ আর বিস্তৃত জলরাশি দেখতে দেখতে সবাই তা উপভোগ করলাম। এভাবে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে দুপুরের দিকে এসে পৌঁছলাম অনেক প্রাচীন বিথঙ্গল আখড়ার ঘাটে।

হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলায় বিথঙ্গল গ্রামে বিথঙ্গল বড় আখড়া বা বিথঙ্গল আখড়ায় দুপুরে পৌঁছে প্রচণ্ড রোদের মাঝে পড়লাম। আখড়ায় জুতা খুলে প্রবেশ করামাত্র পায়ের নিচে টের পেলাম আগুনে গরমের তীব্রতা। গরমের তীব্রতাকে উপেক্ষা করেই মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত আখড়াটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। একপর্যায়ে আখড়ার একজন সেবক জানালেন, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত এ আখড়া। রামকৃষ্ণ গোস্বামী উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দিতে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর প্রাচীন নির্মাণ কৌশল সমৃদ্ধ দুটি ভবন নির্মাণ করে দেন। মানিক্য বাহাদুর ও তার স্ত্রী এতে প্রায়ই এসে অবস্থান করে ধর্মকর্ম করতেন।

মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বিথঙ্গল বড় আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য পৃথক কক্ষ রয়েছে। এখানে যথাযোগ্য ভাব-গাম্ভীর্য্যের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে আছে- আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রথযাত্রা, ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার ৫ দিন পর পঞ্চম দোল উৎসব, কার্তিক মাসের শেষদিনে ভোলা সংক্রান্তিতে কীর্তন, চৈত্রের অষ্টমী তিথিতে পূণ্যস্নান ও বারুনী মেলা ইত্যাদি।

তিনি আরও জানালেন, এ আখড়ার অন্যতম নিদর্শনের মধ্যে সুসজ্জিত রথ, পিতলের সিংহাসন, ২৫ মণ ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি, রৌপ্যপাত্র ও সোনার মুকুট উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিথঙ্গল বড় আখড়া পরিদর্শন করতে আসেন।

আখড়া দেখার পর পুকুরে ডুবসাঁতার দিতে দিতে মনে হলো প্রাচীন ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আখড়াটি পরিচর্যার অভাবে তার সত্যিকারের সৌন্দর্য দিনে দিনে হারিয়েছে। গোসল সেরে আখড়ার নানা আচার-অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে ক্ষুধা পেয়ে গেল। বিথঙ্গল আখড়ার পাশেই হাওরের কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা একটি খাবারের দোকানে ছোলাভূনা, মিষ্টি ও দই-চিড়া খেয়ে আবারও নৌকায় উঠলাম। উদ্দেশ্য কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার শেষপ্রান্তে অবস্থিত দিল্লির আখড়া।

লক্ষ্মীর বাওর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রাচীন দিল্লির আখড়ায়। স্থানটি দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের বদান্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে এর এমন নামকরণ হয়েছে বলে জানা যায়। প্রায় ৪০০ বছর আগের এক মিথ নিয়ে স্থানটি আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আখড়ার চারপাশে আছে অসংখ্য হিজল গাছ। গাছগুলো এখানকার প্রচলিত মিথের অংশ। প্রায় ৩৭২ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা আখড়াটি নারায়ণ গোস্বামীর হাতে প্রতিষ্ঠিত। হিজল গাছ, হাওরের সৌন্দর্যে চমৎকার একটি স্থান দিল্লির আখড়া।

প্রায় ৪০০ বছর আগে জায়গাটির পাশ দিয়ে দিল্লির সম্রাট প্রেরিত একটি কোষা নৌকা মালামালসহ ডুবে যায় এবং একজন সাপের কামড়ে মারা যায়। এ কথা শুনে পার্শ্ববর্তী বিথঙ্গল আখড়ার গুরু রামকৃষ্ণ গোস্বামী তার শিষ্য নারায়ণ গোস্বামীকে এখানে পাঠান। টানা সাত দিন তিনি এখানে রহস্যজনক নানা শক্তির সম্মুখীন হন এবং পরবর্তীতে এখানে বসবাস করা অসংখ্য দানব মূর্তিকে আধ্যাত্মিক শক্তিবলে হিজল গাছে রূপান্তর করেন। আর সম্রাটের ডুবে যাওয়া নৌকাটিও উদ্ধার করে দেন। খুশি হয়ে সম্রাট জায়গাটি আখড়ার নামে দান করে দেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২১২ সালে আখড়ার নামে একটি তামার পাত্রে ওই জমি লিখে দেন। কিন্তু ১৩৭০ সালে ডাকাতরা তা নিয়ে পালিয়ে যায়।
এসব প্রাচীন আখ্যান ভাবতে ভাবতে আখড়ার ভবন, গাছে অজস্র পানকৌড়ি ও বকের বাসা, বাচ্চাকে খাওয়ানোর দৃশ্য, ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির সারি সারি হিজল আবৃত পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে আখড়ার একপাশে দেখলাম মার্বেলের মতো মাটির গোল গোল বল শুকাতে দেওয়া আছে। এখানকার ভক্তরা বিশ্বাস করে আখড়ার মাটির এই মার্বেল খেলে না-কি নানা রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। তাই পুরোহিতদের হাতে গড়া ও তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করে ফুঁ দিয়ে দেওয়া এসব মাটির মার্বেল আখড়ার ভক্তরা বিশ্বাস নিয়ে খায় এবং বাড়িতে রাখে। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’- আমার মস্তিষ্কের যুক্তির জায়গায় বারবার ঘোরা শুরু হলো। বিভিন্ন বিষয় ভাবতে ভাবতে আখড়ার ভেতরে দেখে ফেললাম আধ্যাত্মিক সাধক নারায়ণ গোস্বামী ও তার শিষ্য গঙ্গারাম গোস্বামীর সমাধি, ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা ও বৈষ্ণবদের থাকার ঘর এবং আখড়ার দু’দিকের দুটি পুকুর।

প্রতিবছর চৈত্র মাসে এখানে মেলা বসে। মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের নানা অঞ্চলের মানুষের সমাবেশ দেখা যায়। এ ছাড়া প্রতি অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার রাতে এখানে ভোগ দেওয়া হয়।

হিজলের বনে তখন সূর্য তার শেষ আলো দিয়ে ডুবে যেতে শুরু করেছে। আমরা সারাদিনের অজস্র ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে বজরায় চেপে হবিগঞ্জে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ফেরার পথে বজরার ছাদে শুয়ে আকাশের নানা রং বদল দেখা এবং হঠাৎ নেমে আসা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অপার্থিব অনুভূতি দিয়েছিল।

বছরের বিভিন্ন সময়ে বিথঙ্গল ও দিল্লির আখড়ায় যাওয়া গেলেও বর্ষা ও শরতের শেষ অবধি বা যতদিন হাওরে পানি থাকে; ততদিন পর্যন্ত এখানে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। ঢাকার সায়েদাবাদ বা মহাখালী থেকে বাস যায় হবিগঞ্জের দিকে। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শুরু করে আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা পরপর বাস ছেড়ে যায়। চাইলে রাতের উপবন ট্রেনে চলে যেতে পারেন। রাত দশটায় উপবন ছাড়ে এবং শায়েস্তাগঞ্জ থামে রাত তিনটায়। সেখান থেকে অটোতে হবিগঞ্জ। হবিগঞ্জ শহরে এসে সেখান থেকে কালাডুবা ঘাট যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় উঠতে হবে। ঘাট থেকে দরদাম করে বিথঙ্গল যাওয়ার ট্রলার বা বজরা ভাড়া করে ভেসে পড়ুন হাওরের সবুজ জলে। চাইলে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলি বা বাজিতপুর থেকেও যাত্রা করতে পারেন। সময় দুই ঘণ্টা লাগবে।

বিশ্রামের জন্য হবিগঞ্জ শহর বা বানিয়াচংয়ের আবাসিক হোটেলে থাকতে পারেন। আর খাওয়ার জন্য হবিগঞ্জ শহরই ভরসা। আখড়ার আশেপাশের ছোট্ট দোকানগুলো সাময়িক ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাবে। বিথঙ্গল ও দিল্লির আখড়ায় যাত্রার সময় সঙ্গে শুকনো খাবার ও পানি নিতে ভুলবেন না।

একজন পর্যটক হিসেবে যেখানেই যাবেন, দয়াকরে আপনার দ্বারা ভ্রমণ স্থানের কোনো প্রকার সৌন্দর্যহানী যেন না ঘটে।
লেবেলসমূহ:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger][facebook]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

আজকের দেশ সংবাদ . Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget