ভিয়েতনামে দেখা মিলল বাবুই পাখির

ভিয়েতনামে দেখা মিলল বাবুই পাখির

বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী: ভিয়েতনামের তিয়েন গিয়াং প্রদেশের প্রশস্ত মেকং নদীর ধার ঘেঁষে বেড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা । এ শহরের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেল স্টেশনের কাছে এসে হঠাৎ করে পাখির কিচিরমিচির শব্দে থমকে যেতে হয়। সামান্য দূরেই নানা ধরনের পাম ও কাঁটাওয়ালা গাছে তখন বাবুই পাখি (ভিয়েতনামে বলে রং রোক) তার বাসার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে এবং ওড়াউড়ি করছে। এতোগুলো বাবুই পাখির সুললিত কলতানে উৎফুল্ল মন ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যায় ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায়।

একসময় বাংলাদেশের শহর ও বিশেষ করে গ্রামগুলোতে প্রচুর তাল, নারিকেল, খেজুর, সুপারি ও বাবলা গাছ ছিল। ভাদ্র মাসে তাল গাছের পাশ দিয়ে গেলে পাকা তালের মৌ মৌ ঘ্রাণে প্রাণ জুড়িয়ে আসত। ভাগ্যে থাকলে গাছ তলায় গেলে পাওয়া যেত লালচে-কালো পাকা তাল। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন চারপাশে মাটি ফেটে চৌচির, এমন গরমে তেষ্টা মেটাতে ভরসা হয়ে উঠত বাড়ির আশেপাশের নারিকেল গাছ। শীতের সকালে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে খেজুরের রস খাওয়াও ছিল মুগ্ধকর। গ্রামবাংলার গৃহিণীদের বিকেলের পান খাওয়ার আড্ডা আরও বাড়িয়ে তুলতো বাড়ির পেছনের সুপারি গাছগুলো। আর রৌদ্রজ্বল দিনে বিস্তীর্ণ মাঠের আলের পাশে বাবলা গাছের নিচে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিত কৃষক। এমনই সব দৃশ্য গ্রামবাংলাকে আরও চিরসবুজ ও মাটির কাছাকাছি করে তুলতো।

এসব উঁচু উঁচু তাল, নারিকেল, সুপারি, কাঁটাওয়ালা খেজুর ও বাবলা গাছে বাসা বাঁধতো বাবুই পাখি। উঁচু ও কাঁটাওয়ালা গাছ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ শিকারীর কাছ থেকে নিজেকে ও বাসাকে সুরক্ষিত রাখা। বলা যায়, পৃথিবীতে বাবুই প্রজাতির সংখ্যা ১১৭। এর মাঝে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখি দেখা যায়-
১. দেশি বাবুই: প্রজনন ঋতু ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী পাখির কালো কালো দাগসহ পিঠ হয় তামাটে বর্ণের, নিচের দিকে দাগ নেই, শুধুই তামাটে। ঠোঁট পুরু, মোচাকার; লেজ চৌকা, প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির পিঠ হয় গাঢ় বাদামি। হলুদ বুকের উপরের দিক ফ্যাকাশে।
২. দাগি বাবুই: বুক তামাটে, তাতে স্পষ্ট দাগ।
৩. বাংলা বাবুই: প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির মাথার চাঁদি উজ্জ্বল সোনালি-হলুদ, গলা সাদা এবং তা একটি কালো ডোরা দ্বারা নিচের তামাটে-সাদা রঙের অংশ থেকে পৃথক। অন্য সময় স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চাঁদি পিঠের পালকের মতোই বাদামি। বুকের কালো ডোরা ততটা স্পষ্ট নয়। প্রকট ভ্রূরেখা, কানের পেছনে একটি ফোঁটা। (বাংলাপিডিয়া)

বাবুই খুব সুন্দর করে শৈল্পিক বাসা বোনে বলে একে ‘তাঁতি পাখি’ নামেও ডাকা হয়। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল আর আকৃতিও খুব সুন্দর। বাবুই পাখির বাসা দেখতে অনেকটা উল্টানো কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই ভীষণ পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ও কাদার মিশ্রণ ঠিক করে। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে ঘষে গোলাকার অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা তৈরি করে। অন্যদিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ বানায়। বাবুই সাধারণত দুই ধরনের বাসা তৈরি করে। মজার বিষয় হলো, পুরুষ পাখি তার পরিশ্রম ও শৈল্পিকতার মিশ্রণে এসব বাসা তৈরি করে। একটি বাসা তৈরি হতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। শৈল্পিক নিদর্শনের এমন দারুণ সব বাসা বাতাসের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে মানুষের মনে আনন্দ দেয়।

বাবুইয়ের বাসা তৈরি করার জন্য প্রয়োজন পড়ে নলখাগড়া, খেজুর পাতা ও হোগলার বন। কিন্তু বাংলাদেশে নলখাগড়া ও হোগলার বন কমে যাওয়ার পাশাপাশি তাল, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, বাবলা গাছও অনেক কমে এসেছে। ফলে বাবুইয়ের সংখ্যাও এখন খুবই কম। বাবুই পাখির অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। বাংলাদেশে বাংলা ও দাগি বাবুইয়ের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। তবে দেশি বাবুই এখনো দেশের অনেক গ্রামের গাছে দলবেঁধে বাসা বোনে।

সময়ের পরিক্রমা, অসচেতনতা, পরিবেশে বিপর্যয়সহ নানা কারণে আজ বাবুই পাখি ও এর বাসা হারিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তিতে পাওয়া যায়, পুরুষ বাবুই পাখি সন্ধ্যা-রাতে ঘর আলোকিত ও প্রেয়সীকে আকৃষ্ট করার জন্য মিটমিট করে জ্বলতে থাকা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে আসে। এনে বাসার দেয়ালে কাদার মাঝে গুজে রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দিয়ে মুক্ত স্বাধীনতার সুখে উড়তে থাকে। বহমান কালের পরিক্রমায়, বাবুই পাখি এখন মুক্ত স্বাধীন সুখ হারিয়ে জোনাকির আলোর মতো মিটমিট করে কোনমতে টিকে আছে বাংলাদেশের গ্রামের আনাচে-কানাচে।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি ভিয়েতনামের বয়স্ক লোকটির পাখির খেলা দেখানো শেষ হয়ে এসেছে। আমি বিষণ্ন মনে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সি নিলাম ক্যান হোচ গ্রামের হোম স্টের উদ্দেশ্যে। যেখানে নাকি সন্ধ্যা-রাতে জোনাকি পরম স্বাধীনতার সুখে বাবুই পাখির বাসায় নিজেই আলো জ্বেলে আসে।
লেবেলসমূহ:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Blogger
Facebook

Emoticon
:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

আজকের দেশ সংবাদ . Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget