এইচ এম কামাল,নেত্রকোনা : তিন বছর ধরে নিজ গৃহে শিকলবন্দী অবস্থায় আবদ্ধ ঘরে জীবন কাটাচ্ছেন নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ফুল মিয়া (৬০) নামে এক বৃদ্ধ। বিরিশিরি ইউনিয়নের পিপুলনারী গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে ফুল মিয়াকে মাথায় সমস্যা আছে বলে তিন বছর ধরে ঘরের একটি নির্জন কক্ষে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের পিপুলনারী গ্রামে বৃদ্ধ ফুল মিয়াকে একটি নির্জন কক্ষে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
শিকলবন্দী ফুল মিয়া বলেন, আমি কোনো পাগল নই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। আমাকে শিকলবন্দী করে পাগল বানানোর নাটক করা হচ্ছে। আমাকে পাগল বানিয়ে ঘরবন্দী করে রেখেছে সুরুজ আলী, মাওলানা রফিকুল ইসলামসহ আরও ৩-৪ জন। শিকলবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন বৃদ্ধ ফুল মিয়া।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৭ বছর আগে ফুল মিয়া মাটির নিচ থেকে (ধাতব জাতীয়) মূল্যবান একটি পাথর খুঁজে পান। সেটি ২০০৩ সালে চৈত্র মাসের শুরুর দিকে। পাথরটি তার স্ত্রীর কাছে দেন লুকিয়ে রাখতে। ফুল মিয়া ওই পাথরটি বিক্রি করতে পার্টির খোঁজে বের হন। পরে তিনি বাড়ি এসে স্ত্রীর কাছে পাথরটি চাইলে তখন তার স্ত্রী বলে পাথরটি সুরুজ মিয়া ও মাওলানা রফিকুল ভাইয়ের কাছে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এ কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে স্বামী ফুল মিয়া ঘরে থাকা বঁটি দিয়ে তার স্ত্রীর গলায় কোপ দেন। এতে ঘটনাস্থলেই স্ত্রী আমেনা খাতুন মারা যান।
২০০৩ সালের বৈশাখ মাসের ৬ তারিখ এ হত্যার ঘটনা ঘটে বলে জানান বৃদ্ধের ছেলে আবু হানিফা। খবর পেয়ে পুলিশ ফুল মিয়াকে গ্রেফতার করে। নিহতের ভাই বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় ১২ বছর ৫ মাস ১৭ দিন জেল খাটেন ফুল মিয়া। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘদিন এলাকায় ঘোরাফেরা করেন। পরে পাথর বিক্রি করে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে বলাবলি করলে ক্ষেপে যান সুরুজ মিয়া ও রফিকুল ইসলাম। এরই জের ধরে ফুল মিয়ার ছেলেদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বাবাকে শিকলবন্দী করে রাখার জন্য বলেন সুরুজ আলী ও রফিকুল ইসলাম। ফলে করে ঘরে বন্দী করে দুই পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ফুল মিয়ার।
শিকলবন্দী ফুল মিয়া আরও বলেন, মাওলানা রফিক ও সুরুজ আলীর এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাইতো। এখন তারা শত কোটি টাকার মালিক। ওই ধাতব জাতীয় পাথর বিক্রি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। আমার সন্তানদেরকে পোষ্য বানিয়ে তারা কৌশলে আমাকে পাগল বানিয়ে রেখেছে। আমি এই শিকলবন্দী জীবন থেকে মুক্তি চাই।
ফুল মিয়ার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার ছেলে আবু হানিফা জানান, বাবার মাথায় সমস্যা থাকায় ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। গত তিন বছর ধরে ঘরের খাটের সঙ্গে শিকল দিয়ে দুই পা বেঁধে রাখা হয়েছে। শিকল বাঁধা অবস্থায় ঘর থেকে বারান্দা পর্যন্ত চলাচল করতে পারেন। ওই নির্জন কক্ষের ভেতরেই পায়খানা-প্রসাব করেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া ঘুমানো সবই চলে ঘরের ভেতরে।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, ফুল মিয়া মূলত পাগল না। তাকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে। এটা অমানবিক ঘটনা। তাকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করতে প্রশাসনের লোকদের এগিয়ে আসা উচিত।
ফুল মিয়াকে শিকলবন্দী করে রাখার ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে মোবাইলে জানতে চাইলে সুরুজ আলী সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন।
অপর অভিযুক্ত মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, ফুল মিয়াকে শিকলবন্দী করে রাখার ব্যাপারে আমি জড়িত নই।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম বলেন, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। শিকলবন্দী বৃদ্ধকে অচিরেই উদ্ধার করা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন