রাশেদুল হাসান: ২ জুন থেকেই শরীরে হালকা জ্বর ও কাশি দেখা দেয় ফেনী শহরের ব্যবসায়ী নুরুজ্জামানের। প্রথম চারদিন চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান তিনি। এটাতে রোগ না সারলে ৬ জুন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কাছ থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিয়ে ওষুধ সেবন শুরু করেন। এরই মাঝে কাশি বেড়ে শ্বাসকষ্ট ও গলাব্যাথা শুরু হয় তার। পরে ১২ জুন ফেনী জেনারেল হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার নমুনা দেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত নমুনার ফলাফল জানতে না পেরে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
উপসর্গ থেকে এ পর্যন্ত ২১ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ফলাফল জানতে না পেরে স্বজনদের মাঝেও হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কিছুটা সুস্থতা অনুভব করায় এখন ওই ব্যবসায়ী তার প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত হয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে তার আশপাশের ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও স্বজনরা।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, ফেনীতে এখন নুরুজ্জামানের মতো রোগীর সংখ্যা অনেক রয়েছে। অনেকেই নমুনা দিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিনেও ফলাফল পাচ্ছে না। নতুনভাবে উপসর্গে আক্রান্তরা নমুনা দিতে এসেও কিট সংকটের কারণে সিরিয়াল পাচ্ছে না। এরই মধ্যে প্রতিদিনই করোনা উপসর্গে ফেনীতে মানুষ মারা যাচ্ছে। রোগী শনাক্তে ধীরগতি ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে না পারায় ফেনীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমণ।
এদিকে ফেনীতে ৫ দিন ধরে কিট সংকটের কারণে নমুনা পরীক্ষা বন্ধ থাকায় সংক্রমণ ঝুঁকিও বাড়ছে। পরীক্ষাগারে আটকে আছে আরও ১২৭৩ জনের সংগৃহিত নমুনা। এছাড়া সংক্রমণ ঠেকাতে ফেনীর ১০ এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করা হলেও কিছু কিছু এলাকায় তা মানা হচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাস্তার মোড়ে বাঁশ লাগিয়ে পথ বন্ধ করা হলেও তদারকি না থাকায় স্থানীয়রা নিজের ইচ্ছে মতো ঘোরাফেরা করছেন।
জেলা করোনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সমন্বয়ক ডা. শরফুদ্দিন মাহমুদ জানান, ফেনীতে এখন করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় রয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নমুনা সংগ্রহের আবেদন। বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কিন্তু হঠাৎ কিট সংকটে রোগী শনাক্তকরণ কাজ থমকে গেছে। শনাক্ত না হওয়ায় রোগী নিজের অজান্তে তার সোসাইটিতে বিচরণ করে সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। গত ১৯ জুন থেকে কিট সংকটের কারণে ফেনীতে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেড়েছে।
তিনি জানান, ১৬ এপ্রিল ফেনীতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ফেনী থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন্স ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হতো। কিন্তু সেখানে চট্টগ্রাম বিভাগের ছয় জেলার নমুনা পরীক্ষার কারণে সব সময় জটলা লেগে থাকতো। ফলাফল পেতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যোত। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে করোনা নমুনা পাঠানোর জন্য বলা হয়। এ কলেজে রিপোর্ট পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমে এলেও হঠাৎ ২০ জুন থেকে কিট না থাকায় নমুনা পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়।
অপরদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, ফেনী থেকে এ পর্যন্ত করোনা উপসর্গে ভোগা ৪ হাজার ৫৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৭১ জনের ফলাফল এসেছে। যার মধ্যে ৬৫৩ জনের করোনা পজিটিভ। এখন পর্যন্ত পরীক্ষাগারে ১ হাজার ২৭৯ জনের নমুনা আটকে আছে। ফলাফল প্রাপ্তদের মধ্যে মারা গেছেন ১৪ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৩৫ জন। বর্তমানে হাসপাতালে আইসোলেশনে ভর্তি আছেন ৪৫ জন। উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠানো হয়েছে ১৩ জনকে। বাকি রোগীরা নিজ গৃহে আইসোলেশন করে স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শে চিকিৎসাধীন।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) মো. ইকবাল হোসেন ভূঞা জানান, কিট সংকট থাকায় নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ থেকে নমুনা পাঠাতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা শুক্রবার (১৯) থেকে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রেখেছি। কিট পাওয়া গেলে পুনরায় নমুনা সংগ্রহ করা হবে।
জেলা ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মাসুদ রানা জানান, কিট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অফিসিয়াল ও নন অফিসিয়ালভাবে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা চলছে। আশা করা যায় শিগগিরই কিটের ব্যবস্থা হবে।
নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের ল্যাব ইনচার্জ ডা. ফজলে এলাহী জানান, প্রতিদিন ফেনী থেকে আসা ১৮০ থেকে ১৯০টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আমরা দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু গত কয়েকদিন কিট না থাকায় তাদের নমুনা পাঠাতে বারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের ল্যাবে ফেনীর ১২৭৯ জনের নমুনা পড়ে আছে। কিট পাওয়া গেলে আবারও কার্যক্রম চালু করা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন