আম সংগ্রহের উদ্বোধন
তন্ময় ভৌমিক, নওগাঁ: নওগাঁর পোরশায় সরকারি ভাবে নিরাপদ আম সংগ্রহের উদ্বোধন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার মিনা বাজারের এলাকায় এর উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হামিদ রেজা।
উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের আয়োজনে এ সময় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ মঞ্জুর মোরশেদ চৌধুরী, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আলম, পোরশা আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সামাদ শাহ চৌধুরীসহ অন্যন্যারা।
পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আলম জানান, গত ২৫ মে সরকারি ভাবে গোপালভোগ আম সংগ্রহ শুরু করার নির্ধারিত দিনক্ষণ থাকলেও আম পরিপক্ক না হওয়ায় তিনদিন পর আম সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এঁটেল মাটির কারণে এখানকার আম অন্য জেলার চেয়ে সুস্বাদু ও মিষ্টি। সেখানে কোন রকম রাসায়নিক দ্রব্য ও বিষ দেন না আম চাষিরা।
এদিকে, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি ঢাকা থেকে জেলা, স্থানীয়, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, পরিবহন মালিক, আম ব্যবসায়ী ও চাষিদের সাথে ইত্যে পূর্বে কয়েকবার ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। সেই কনফারেন্সে আম ব্যবসায়ীদের আম কেনা-বেচা করতে সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা দিতে ও সারাদেশে থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামপুরসহ নওগাঁয় স্বাভাবিক ভাবে আম কিনে সারাদেশে সরবরাহ করতে পাবেন সেই নির্দেশণা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।
সে সময় খাদ্যমন্ত্রী আরো বলেন, যে সব জায়গা থেকে আম ও লিচু যাবে, রাস্তায় কোন ট্রাক যেন প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়ে, সে জন্য দৃষ্টি রাখবে সরকার। অ্যাপসের মাধ্যমে শুধুমাত্র আমের বাজারের সাথে নয়, পরিবহনের সাথেও যোগাযোগ থাকবে। সরকারী পরিবহনের সাথে, এমনকি বন্দরে ট্রাক কাভার্ড ভ্যানের সাথেও যুক্ত থাকবে। এছাড়াও ৮টি সংস্থার সাথে সংযুক্ত থাকবে। তাদের বললেই সেখানে চলে গিয়ে নিয়ে আসবে এসব পণ্য। আম নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার পর খালি ট্রাক ফিরে গেলে যমুনা সেতুতে টোল ৫০ ভাগ নেয়া হবে। পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীদের খাদ্যে কলার পরিবর্তে আম দেয়া, পুলিশ ব্যারাকে আমের বাজার গড়ে তোলা, সেনাবাহিনীতে আমের বাজার গড়ে তোলা ইত্যাদি ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে আম চাষীরা আমের নায্য মূল্য পায়। সে জন্য নওগাঁর জেলা প্রশাসক হারুন-অর রশীদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
সরজমিনে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে আমের বাম্পার ফলন হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে অন্য বছরের মতো নওগাঁয় আম চাষিরা এখন পর্যন্ত আম বাগান বিক্রি করতে পারেনি। ফলে আম বাগান বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তাই রয়েছেন তারা। এদিকে সারাদেশে আম সরবরাহের সময় রাস্তায় পুলিশের চাঁদাবাজি ও হয়রানির কারণে সঠিক সময় মোকামে আম পৌঁছাতে না পারায় অনেক সময় তাদের লোকসান গুণতে হয় বলে আম ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। ১৯ মে সাপাহারে পুলিশের উদ্যোগে আম ব্যবসায়ী ও চাষিদের সাথে পুলিশের মতবিনিময় শেষে পুলিশী হয়রানি বন্ধে শতভাগ আশ্বাস দেন পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান। জেলায় এই প্রথম আম ব্যবসায়ী ও চাষিদের সাথে পুলিশের মতবিনিময়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আম ব্যবসায়ী ও চাষিরা বলছেন, পুলিশের সহযোগিতা পেলে জেলার বিভিন্ন জেলা থেকে আম ব্যবসায়ী আসবেন। ফলে নওগাঁর আম ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক এএফএম গোলাম ফারুক হোসেন জানান, ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্র ভূমি হিসেবে পরিচিত নওগাঁয় অন্যান্য ফসলের চেয়ে আম চাষে বেশি লাভ হওয়ায় আম চাষ ঝুঁকে পরেছেন। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পতœীতলা উপজেলার কৃষকরা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আম চাষ করে থাকেন। চলতি বছর ২৪ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। যা থেকে নওগাঁয় ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ।
সাপাহারের তছলিম উদ্দিন, ফারুক হোসেনসহ অন্য আম চাষিরা জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর আমও ভালো হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে নওগাঁ থেকে বিদেশেও আম রপ্তানি হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে নওগাঁয় এখন পর্যন্ত কোন আম চাষি আম বাগান বিক্রি করতে পারেনি। ফলে আম চাষিরা খরচের টাকা তুলতে পারবেন কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তাই রয়েছেন।
জানা গেছে, জেলার সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পতœীতলার আমকে কেনাবেচা হয় সাপাহারে। সাপাহারে প্রতি বছর দেড়শ’ থেকে ২শ’ আম আড়ৎঘর আছে। প্রতি বছর শতশত আম ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আম ব্যবসায়ীরা সাপাহারে এসে আম কিনে নিয়ে যান। প্রতি বছর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আম কেনা বেচা শুরু হলেও চলতি আম মৌসুমে আম না পাকায় নওগাঁয় এখনো কেনাবেচা শুরু হয়নি।
সাপাহার আড়ৎ ব্যবসায়ী ওমর ফারুক, জহির উদ্দিন জানান, ইত্যে মধ্যে আড়ৎ ব্যবসায়ীরা তাদের আড়ৎতের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছেন। আর কয়েক দিন পর থেকে আম সংগ্রহ করে কেনা বেচা পুরোদমে শুরু হবে।
সাপাহার আম আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক নেতা ও সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইত্যে মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আম ব্যবসায়ীরা যাতে নায্য মূল্য পান এবং রাস্তায় কোন হয়রানি না করা হয় সে জন্যে বিভিন্ন দিকনির্দেশণা দিয়েছেন। এই নির্দেশণা প্রশাসন বাস্তাবায়ন করলে তাদের কোন সমস্য হবে না। তিনি আরো জানান, জেলায় এই প্রথম আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের মত বিনিময়কে আমরা সাধুবাদ জানাই। এর আগে কখনও পুলিশের কোন কর্মকর্তা এ ভাবে এগিয়ে আসেননি।
সাপাহার আম আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ইনাম রিফাদ উদ্দিন জানান, সাপাহার থেকে সারাদেশে আম সরবরাহের সময় রাস্তায় পুলিশের চাঁদাবাজি ও হয়রানিতে সঠিক সময় নির্দিষ্ট স্থানে আম পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সময় তাদের লোকসান গুণতে হয় বলে জানিয়েছেন আম ব্যবসায়ী নেতারা।
পোরশা আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সামাদ শাহ চৌধুরী জানান, পোরশায় আমপানসহ কয়েকটি ঝড়ে আমের ক্ষতি হলেও অন্য জেলাতে আম না থাকায় নওগাঁর আম ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হামিদ রেজা জানান, আম ব্যবসার জন্যে অনলাইন, পরিবহণ, ট্রেনসহ সরকারি ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আম চাষিরা আমের ভালো দাম পাবেন।
সাপাহার আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কার্তিক সাহা জানান, প্রতি বছর শুধু সাপাহারে ৭শ’ কোটি টাকা থেকে সাড়ে ৭শ’ কোটি টাকার আম কেনা বেচা হয়। তবে এ বছর আরো বেশি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, ঝড়ে নওগাঁয় ৩ভাগ আমের ক্ষতি হয়েছে। যে সকল জেলায় আম নেই সেই সব জেলায় আম সরবরাহ করা সম্ভব ও ভালো দাম পেলে ক্ষতি পুষিয়ে আম ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।
নওগাঁ চেম্বার অফ কমার্স ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ইকবাল হোসেন শাহারিয়া জানান, চলতি আম মৌসুমে গত বছরের তুলনায় আম বেশি চাষ হওয়ায় নওগাঁয় প্রায় ৮শ’ কোটি টাকার আম কেনা-বেচার সম্ভাবনা রয়েছে।
পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া জানান, আম চাষিদের জন্যে সরকারি ভাবে ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাপাহারে পুলিশী কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হবে; যাতে শুধু নওগাঁ নয়; রাজধানীসহ সারাদেশে আম সরবরাহ করতে পারেন আম চাষিরা সে জন্যে পুলিশের বিশেষ নজরদারি থাকবে। এছাড়াও রাস্তায় বিভিন্ন ভাবে আম চাষি ও ব্যবসায় যে হয়রানি বন্ধে শতভাগ আশ্বাস দেন।