বিশেষ
প্রতিবেদক: চাঁদপুর
জেলার অন্তর্গত মতলব-দক্ষিণ উপজেলার আওতাধীন খাদেরগাঁও ইউনিয়নের পুটিয়া গ্রামের আব্দুল
করিম প্রধানীয়া বাড়ির ১৫টি পরিবার বড়ই অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করে আসছিলেন। বাড়ি থেকে
চলাচলের জন্য তাদের কোন রাস্তা ছিল না। তারা ছিলেন অনেকটা বিছিন্ন দ্বীপের মত। বাড়ির
আশে-পাশে থাকা নালা-নর্দমা ও খানা-খন্দ মাড়িয়ে তাদের বাইরে আসতে হোত। এভাবে তাদের বিশ
বছর কেটে যায়। চলাচলের রাস্তা বের করার জন্য তারা অনেক চেষ্টা-তদ্বির করেছেন। করেছেন
অনেক সালিশ-দরবার। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। উল্টো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং শান্তি
ভঙ্গ হয়েছে। চলাচলের এই রাস্তা বের করার জন্য বহুদিন যাবৎ এলাকায় বিরোধ চলছিল। এই নিয়ে
দু’পক্ষের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-ঝাট্টি ও মারামারি হোত।
একদিন এই মারামারিকে কেন্দ্র
করে ভূক্তভূগী মোঃ হাসেম খান (পিতা: মৃত গফুর খান) আবু তাহের গঙদের বিরুদ্ধে ৮ জুলাই
২০১৯ তাদের খাদেরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে ১০ টাকা ফি প্রদান সাপেক্ষে একটি
ফৌজদারী মামলা দায়ের করেন। গ্রাম আদালত উক্ত মামলাটি আমলে নিয়ে ঐ মাসের ১৫ তারিখে গ্রাম
আদালতে হাজির হওয়ার জন্য মামলার প্রতিবাদীদের প্রতি সমন জারি করেন। সমন পেয়ে মামলার
প্রতিবাদীগণ ইউনিয়ন পরিষদে হাজির হন এবং নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। গ্রাম আদালত
বিধিমালা ২০১৬ এর বিধি-৩১ মোতাবেক উক্ত মামলায় কোন আপোষরফা না হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান গ্রাম আদালত গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং আদালতে বিচারিক প্যানেল সদস্য
মনোনয়নের জন্য উভয় পক্ষকে আদেশ দেন।
আদালতের আদেশ মোতাবেক ২২
জুলাই ২০১৯ আবেদনকারী ও প্রতিবাদী গ্রাম আদালতের নির্দিষ্ট ফরমে
প্রত্যেকে দুই জন করে মোট চার জন বিচারিক প্যানেল সদস্য মনোনীত করেন এবং যথানিয়মে তা
আদালতে দাখিল করেন। এরপর ৮ আগষ্ট ২০১৯ চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জর হোসেন রিপনের সভাপতিত্বে
গ্রাম আদালতের এজলাস কক্ষে মামলার প্রথম শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। শুনানীর সময় মামলার উভয়
পক্ষ এবং সাক্ষ্যীদের জবানবন্দী নেওয়া হয়। জবানবন্দী অনুযায়ী মামলার বিচার্য বিষয় নির্ধারণকালে
স্পষ্ট হয় যে, মারামারির সূত্রপাত হয় চলাচলের রাস্তা নিয়ে। এ মতাবস্থায়, মামলার বিচার্য-বিষয়
মারামারির পাশাপাশি চলাচলের রাস্তার প্রতিবন্ধকতা উঠে আসে এবং চলাচলের এই সমস্যা নিয়েই
গত দুই দশক ধরে তাদের মাঝে বিরোধ লেগে আছে। মারামারির বিষয়টি প্রথম শুনানীতে সমাধান
হলেও রাস্তার প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি নিয়ে সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে আদালতে আরেকটি শুনানী
করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৪ আগষ্ট ২০১৯ শুনানীর জন্য নতুন দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়।
সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন
দাখিল হওয়ার পর বিচারিক প্যানেল সদস্যদের নিয়ে আদালতের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সাত
দিনের মধ্যে আবার শুনানী শুরু হয়। শুনানীতে উভয় পক্ষের সাক্ষ্যী সহ সবাই হাজির হন।
প্রাণবন্ত শুনানী শেষে এই মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় যে, প্রস্তাবিত
রাস্তার জন্য উভয় বাড়ির সবাই নিজ নিজ সীমানা থেকে আড়াই ফুট করে উভয় দিক থেকে মোট পাঁচ
ফিট জায়গা মূল সংযোগ রাস্তা পর্যন্ত ছেড়ে দেবেন এবং উক্ত পাঁচ ফিটের মধ্যে কারো কোন
স্থাপনা বা গাছ-পালা থাকলে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে নিবেন। সিদ্ধান্তে আরো ঘোষণা করা হয়
যে, ৩১ আগষ্ট ২০১৯ রোজ শনিবার ইউপি চেয়ারম্যান বিরোধপূর্ণ স্থানের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি
সদস্য এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে উক্ত স্থানটি পরিদর্শন করবেন এবং প্রস্তাবিত
রাস্তাটি উন্মুক্ত করে দিবেন। অর্থ্যাৎ গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান ইউপি চেয়ারম্যানকে
আদালতের রায় বাস্তবায়নের দ্বায়িত্ব দেন।
গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত
মোতাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জর হোসেন রিপন ইউপি সদস্যদ্বয় যথাক্রমে হাবিব উল্লাহ
হবু, মোজাম্মেল হক মিয়াজী, মোঃ মহসিন প্রধান, গ্রাম আদালত সহকারী মোঃ ইব্রাহীম ঢালীসহ
এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গদের নিয়ে সেখানে যান এবং নিজ হাতে উপস্থিত সহযোগীদের
নিয়ে জমি মাপজোক করে চলাচলের জন্য উক্ত প্রস্তাবিত রাস্তার জায়গা বের করেন এবং সবার
চলাচলের জন্য তা উন্মুক্ত করেন। এ সময় সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন খাদেরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী
লীগের সহ-সভাপতি জাহিদুর রহমান জাহাঙ্গীর মিয়াজী ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম
ঢালী। তারা সবাই তাকে সহযোগিতা করেন।
ইউপি চেয়ারম্যানের আন্তরিকতায়
ও গ্রাম আদালতের এমন জনহিতকর সিদ্ধান্তে এলাকার দীর্ঘদিনের একটি বিরোধের অবসান ঘটল
এবং বন্ধীপ্রায় ১৫টি পরিবার সহ এলাকার মানুষ স্বাচ্ছন্দে চলাচলের জন্য একটি রাস্তা
পেল। এতে সবাই খুশী। তাদের ধারণা গ্রাম আদালত এভাবে এগিয়ে গেলে এলাকার মানুষ উপকৃত
হবে।।