নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ‘বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের’ অধ্যক্ষসহ দুইজনের বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। বেতনের জন্য শিক্ষক কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। এতে কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম ও হিসাবরক্ষক রায়হান কবীরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সেইসাথে কলেজের উপাধ্যক্ষ সোহেল রানাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং সহকারী শিক্ষক হেলাল উদ্দিনকে হিসাবরক্ষককে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। গত ২০১৩ সালে বিয়ামে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন রেজাউল করীম।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, প্লে থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৮৭ জন। এছাড়া রয়েছে- শিক্ষক ৩১ জন এবং কর্মচারী ১০ জন। প্লে, নার্সারি ও কেজি’র শিক্ষার্থীদের বেতন মাসে ৪৫০ টাকা, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেনীর বেতন ৫০০ টাকা ও পঞ্চম থেকে দশম শ্রেনীর বেতন ৫৫০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে শিক্ষার্থীর নিকট থেকে বেতন আদায় হয় প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরমধ্য থেকে প্রতিমাসে ৪১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন দিতে প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ বিল, বিদ্যালয় ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় মাসে ২০ হাজার টাকা।
প্রতি বছর শেষন ও ভর্তি ফি থেকে আসে ১৫ লাখ টাকা এবং বছরে তিন বার পরীক্ষা থেকে আয় আসে ৬ লাখ টাকা। শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে বছরে প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে।
গত ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। বেতনের জন্য শিক্ষকরা বার বার অধ্যক্ষ রেজাউল করিমকে তাগাদা দিলে ছাত্ররা ঠিকমতো বেতন দিচ্ছে না বলে তিনি আশ্বস্থ করেন। দিনের পর দিন তিনি শুধু আশ্বস্থ করলেও প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। গত ডিসেম্বর মাসে আবারও বেতনের জন্য শিক্ষকরা হিসাব-নিকাশের জন্য চাপ দিলে অধ্যক্ষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপন করেন।
অবশেষে তৎকালীন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোখলেছুর রহমানকে বিষয়টি অবগত করেন শিক্ষকরা। বিষয়টি নিয়ে সেইসময় ইউএনও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এতে করে শিক্ষকরা অসহায় হয়ে পড়েন। অপরদিকে পাঁচমাসের বেতন না পেয়ে শিক্ষকরা মানবেতর জীবন যাপন করেন। শিক্ষকরা বেতন না পাওয়ায় পাঠদানের আগ্রহ অনেকটা হারিয়ে ফেলেন।
ছাত্ররা নিয়মিত বেতন দেয় কিনা তা নিয়ে শিক্ষকরা সাড়াশি অভিযান শুরু করে। এতে করে শিক্ষকরা জানতে পারেন ছাত্ররা নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে, কিন্তু অধ্যক্ষ শিক্ষকদের বেতন বকেয়া রাখেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের সন্দেহের দানা বাঁধে। পরবর্তীতে নতুন ইউএনও হিসেবে ছানাউল ইসলাম যোগদান করলে অর্থআত্মসাতের অভিযোগ এনে অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। ইউএনও অভিযোগটি আমলে নিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
কলেজের অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ অভিযোগ থাকায় গত ০২/০৭/১৯ ইং তারিখে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি সভায় সিদ্ধান্তে তাদেরকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়। সেইসাথে কলেজের উপাধ্যক্ষ সোহেল রানাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং সহকারী শিক্ষক হেলাল উদ্দিনকে হিসাবরক্ষককে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
অভিভাবক কাকলি রায়সহ কয়েকজন বলেন, আমরা নিয়মিত সন্তানদের স্কুলের বেতন পরিশোধ করি। এখন শিক্ষকরা যদি বেতন না পাই তাহলেতো পাঠদানেও মনযোগ আসবে না। তাই প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাতের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক আরিফুল ইসলাম, যুক্তিবিদ্যার প্রভাষক নাছরিন আরা, উপাধ্যক্ষ নিলুফা ইয়াসমিন সহ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমরা এখানে চাকরি করছি। কিন্তু গত বছর থেকে নিয়মিত বেতন দেয়া নিয়ে সমস্যা শুরু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারীতে দুই মাসের এবং এপ্রিলে এক মাসের বেতন আমাদেরকে দেয়া হয়। কিন্তু মোটের উপর পাঁচমাসের বেতন বকেয়া পড়ে আছে। ছাত্রদের কাছ থেকে ঠিকই বেতন নেয়া হয়। কিন্তু আমাদেরকে বেতন দেয়া হয়না। কলেজে যে পরিমান আয় হয় তা থেকে আমাদেরকে স্বপ্ল পরিমান বেতন দেয়া হলেও কোন উৎসব বোনাস দেয়া হয়না। কিন্তু তারপর বেতন বকেয়া রাখা হয়েছে। আমাদের দাবী তদন্তপূবর্ক দোষীদের ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক।
হিসাবরক্ষক রায়হান কবীর এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চান না। তবে সব স্যারেরা জানেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম বলেন, এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। একটি মহল এটা নিয়ে শিক্ষকদের উষ্কিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিবেন। তবে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ছানাউল ইসলাম বলেন, এসিল্যান্ডকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত চলাকালিন তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিয়ামের পরিচালকের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। বিষয়টি আরো ক্ষতিয়ে দেখা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন