বৈষম্য ও উৎপাদনশীলতা -মোঃ এরফান আলী


বৈষম্য ও উৎপাদনশীলতা
দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক সব নাগরিক সুবিধা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে তা দৃশ্যমান। সমানুপাতিক হারে দেশের এক শ্রেণীর মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ এবং সক্ষমতা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আরো বেশি দৃশ্যমান।

গত ১৬/০১/১৯ইং তারিখে প্রকাশিত Wealth-x, “The Global HNW Analysis” এর প্রতিবেদন মোতাবেক ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে ৩য় স্থান অর্জন করেছে। উক্ত রিপোর্ট প্রকাশের কিছুদিন পূর্বেই
Wealth-x, “The Ultra- Wealthy Analysis” প্রকাশ করে। গত ০৫/০৯/২০১৮ইং তারিখে প্রদত্ত রির্পোট অনুযায়ী অতি ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ ‘পঞ্চম’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই উন্নয়নশীল দেশে কারা এভাবে বজ্রগতিতে ধনী হচ্ছেন? যারা এই তালিকাভূক্ত, তাঁদের অধিকাংশই বৈধ আয়ের মাধ্যমে ধনী হচ্ছেন না। তাদের প্রদত্ত আয়-ব্যয় বিবরণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রকৃত আয়ের কয়েকগুণ তাঁদের সম্পদের পরিমাণ যা অপ্রদর্শিত রয়েছে। তারা যে শুধু সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য এমনটা করছেন তা নয়, বরং আয়ের উৎস প্রদর্শন করা সম্ভবপর নয় বলেই এমনটি করছেন।

দেশের সর্বত্রই এক ধরনের শ্রেণী বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রান্তিক জনগণ যারা কৃষি উৎপাদন করছেন তারা নায্য মূল্য পাচ্ছেন না, পক্ষান্তরে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীরা হাত বদল করেই দ্বিগুণ মুনাফা করছেন। এটি অনাদিকাল থেকেই প্রচলিত এবং দৃশ্যমান।

সম্প্রতি যে খাতে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে তা হলো সরকারি ও বেসরকারি চাকরির মধ্যে পার্থক্য। এ পার্থক্যও যে নতুন তা নয়, কিন্তুু কিছুদিন আগেও তা ছিল উল্টো ধরনের। সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের মোহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তুু ২০১৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৮ম বেতন কাঠামো প্রবর্তনের পূর্বে মেধাবী তরুণরা বেসরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিলেন। ভাল বেতন, চ্যালেঞ্জ, আত্মবিশ্বাসের সুযোগ, নিজেকে দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা প্রভৃতি কারণে তরুণরা বেসরকারি চাকরিতেই নিজের ক্যারিয়ার তৈরিতে অগ্রাধিকার দিতেন। অনেক শিক্ষার্থী মাস্টার্স শেষ হওয়ার পূর্বেই এমবিএ, সিএ, কম্পিউটার ও ভাষা শিক্ষার কোর্স সহ বিভিন্ন প্রফেশানাল কোর্স সম্পন্ন করে বেসরকারি চাকরির বাজারে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকতেন। কিন্তুু ২০১৫ সালে ৮ম বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের পর সরকারি চাকরির বেতন বেসরকারি চাকরির চেয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে। তার সঙ্গে সরকারি চাকুরেরা চিকিৎসা ভাতা, একাধিক উৎসব ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, কাপড় পরিস্কার করার ভাতা, প্রেষণ ভাতা, অ্যাপায়ন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, টিফিন ভাতা, ঝুঁকি ভাতা, গাড়ী খরিদের ঋণ, গৃহ নির্মাণ ঋণ, বাবুর্চি ভাতা সহ নানাধরনের সুবিধায় যেখানে হাবুডুবু খায়; সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন ভাতার সিংহভাগই নেই। তাছাড়া সরকারি চাকরিতে ক্ষমতা আর সামাজিক মর্যাদার হাতছানি মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করছে। ফলে নিরাপদ জীবিকার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে তরুণ প্রজন্ম সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছে।

সরকারি চাকরিতে বেশি বেতন আর বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে এতে আম-জনতার কোন সমস্যা নেই। বরং অধিক বেতন আর সুযোগ সুবিধা পেলে ঘুষ দুর্নীতি কমবে এমনটাই কাম্য, কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। বেতন ভাতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমানুপাতিক হারে ঘুষ-দুর্নীতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের শুরুতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। আমরাও এই আশায় বুক বেঁধে আছি ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে সত্যিকার বৈষম্যহীন সোনার বাংলা নির্মিত হবে।

বি,আই,ডি,এম এর গবেষণা মতে সরকারি চাকরিতে শ্রমশক্তির মাত্র ২ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়। আর বাকী ৯৮% মানুষই বেসরকারি খাতে এমনকি তাদের একটি বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বা আত্ম কর্মসংস্থ’ানে নিয়োজিত। সমস্যাটা  ঠিক এখানেই, যেখানে জিডিপিতে বেসরকারি খাত-ই সিংহভাগ জোগান দিচ্ছে সেখানে তরুণ প্রজান্মকে এভাবে সরকারি চাকরিমুখী করা মোটেই সমীচীন নয়। এদেশে শীর্ষ মেধাবীরা  ডাক্তারী কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এসব মেধাবীরাও ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের পরিবর্তে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান পড়ে প্রশাসনের বড় কর্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। যে ছেলেটি কৃষি বিজ্ঞানে নিয়ে পড়াশুনা করলো, সে কিনা কাষ্টমস্ বা পুলিশ কর্মকর্তা হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।

এই সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে ৪/৫ বার বিসিএস দিয়ে বয়স যখন শেষ তখন চাকরির বয়স বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে হচ্ছে। এভাবেই আমাদের তরুণ প্রজন্ম সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলছে যা কিনা কেউ খেয়াল করছেনা। মেধাবীরা পড়াশুনা শেষ করে ৪/৫ বছর সরকারি চাকরির পেছনে ছোটার কারণে বেসরকারি খাতের জন্য নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারছেন না। এই সুযোগে বিদেশী কিংবা মাল্টিন্যাশনাল তো বটেই, খোদ দেশীয় কোম্পানীর শীর্ষ পদসমূহও দখল করে নিচ্ছে ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকার মত প্রতিবেশী দেশের নাগরিকরা।

দেশে ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ প্রকৃত বেকার। বেকারত্বের কারণে ৭৮ লাখ বাংলাদেশী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। বেকারত্বের এমন চিত্র যে দেশে সে দেশে তিন লাখ বিদেশী নাগরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন। বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা তারা নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে। এক দিকে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা বিদেশে কঠোর শ্রম আর ঘাম ঝরিয়ে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। অপর দিকে তাদের পাঠানো প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ পরিমাণ টাকা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন এখানে কর্মরত বিদেশীরা। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল এবং বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত দেশে এ বিপরীত চিত্র মেনে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।

গত বছর ৫ অক্টোবর ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের খবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য তুলে ধরে বলা হয় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের দি ইকোনমিক্স টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের তথ্যানুযায়ী ভারত যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স (বিদেশে কর্মরতদের পাঠানো অর্থ) আয় করে তার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ থেকে ভারত বছরে চার বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়েক লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কর্মরত রয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশ থেকে এ বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্জন করছে প্রতি বছর।
বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্টস শিল্পের উঁচু পদগুলো বিদেশীদের দখলে রয়েছে মর্মে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা যে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছেন, তা নয়; বরং এ শিল্পের নিয়ন্ত্রণও অনেকটা তাদের হাতে চলে যাচ্ছে।
দক্ষ জনবলের অভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয়সহ বিদেশীরা কর্মরত থাকলেও এ অবস্থা থেকে উত্তরণ তথা দক্ষ জনবল গড়ে তোলার বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষার সাথে বাস্তবতার সমন্বয়হীনতা ও শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি কয়েক বছর ধরে বহুল আলোচিত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আমরা কেউ ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক হওয়ার স্বপ্ন দেখিনা, গবেষক হওয়ার চিন্তা করিনা, ভাল ব্যবসায়ী, সাংবাদিক কিংবা অন্য কোন পেশাজীবী হওয়ার কথা ভাবিনা কারণ সরকারি-বেসরকারি চাকরির বৈষম্য দেখে মেধাবী তরুণরা সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন। এ দেশে সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তা তো বটেই এমনকি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বিত্ত-বৈভব আর ধনী বা অতি ধনীর তালিকায় সামিল হওয়া এই বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। বিশ্বে অতি ধনী বা ধনীর তালিকায় যেমন আমরা শীর্ষ দিকে তেমনি বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী অতি গরিবের তালিকায় বাংলাদেশ ৫ম। কৃষক, পোশাক শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক যারা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে তারাই চরম বৈষম্যের শিকার। দেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়।

আজকের বাজার অর্থনীতির যুগে বেসরকারি খাতই অর্থনীতির প্রাণ। তাই এ খাতের সিংহভাগ মানুষকে বঞ্চনায় রাখা কাম্য নয়। অর্থনীতিতে উৎপাদক শ্রেণীকে গুরুত্ব দিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে সংকোচিত করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হোক। সরকারি- বেসরকারি চাকরির বৈষম্য হ্রাস হয়ে তরুণরা এগিয়ে আসুক। আমাদের তরুণরাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদের জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলুক। এভাবেই এগিয়ে যাক তারুণ্য। আর তরুণদের হাত ধরেই এগিযে যাক প্রিয় মাতৃভূমি।

                                                                         লেখক মোঃ এরফান আলী
                                                                            পরিচালক, মৌসুমী উকিলপাড়া, নওগাঁ

লেবেলসমূহ:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger][facebook]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

আজকের দেশ সংবাদ . Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget