আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ: নওগাঁয় নয় বছরের এক শিশু কবিরাজি পানি পড়া চিকিৎসা দিচ্ছে। আর এ পানি পড়া খেয়ে নিঃসন্তান দম্পতিরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন। এমন গুজব সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে একটি সন্তান জন্মদানের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে শত শত দম্পতিরা ছুটে আসছেন সেই শিশুর কাছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করছেন পানি পড়া নেয়ার জন্য। আর এমন ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটী ইউনিয়নের সরিষপুর গ্রামের হাজী পাড়ায়। কবিরাজের নাম দিপু। বাবার নাম জানা যায়নি। তবে মায়ের নাম দেলেয়ারা বেগম। আর এ পানি পড়াকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমান দোকান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সরিষপুর গ্রাম। গ্রামে প্রবেশ পথে রাস্তার দু’ধারে মাইক্রোবাস, অটোচার্জার ও ভ্যান গাড়ি সারি সারি করে রাখা আছে। রাস্তা থেকে দিপু কবিরাজের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দুরে। রাস্তা থেকে কবিরাজের বাড়ি পর্যন্ত মানুষ লাইন ধরে যাওয়া-আসা করেছেন। হাজী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় একটি আম বাগানের মধ্যে টিনের বেড়া দিয়ে তৈরী একটি ঘর ও বারান্দা। আর এ বারান্দায় বসে পানি পড়া দিচ্ছে শিশু কবিরাজ দিপু। কবিরাজের সামনে একটি দান বাক্স মসজিদের জন্য এবং ঘরের বাহিরে আরেকটি দানবাক্স মন্দিরের জন্য রাখা আছে। যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা বাক্সে নিজেদের ইচ্ছেমত দান করছেন।
আর এ ঘরের আশপাশে অন্তত দেড় হাজার মহিলা প্রত্যেকের হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগের মধ্যে আছে একটি করে পানির বোতল। মহিলাদের সাথে এসেছেন আত্মীয়স্বজন ও স্বামী। আর আম বাগানের মধ্যেই চটি (মাদুর) পেতেই অনেকে শুয়ে-বসে আছেন। আবার অনেকেই রান্নার জন্য খাসি, মুরগি জবাই করছেন। আবার অনেকে সেই রান্না জোগান দিতে পিয়াজ-রসুন বাছাই করছেন।
দিপু কবিরাজের কাছে পানি পড়া নেবার জন্য রাত থেকে এ হাজী পাড়ার আম বাগানে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন। তার বাড়ির দরজা থেকে শুরু হয়েছে লাইন। ফজরের নামাজ পর শুরু হয় পানি পড়া দেয়া। আর এ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক মহিলা ক্লান্ত হয়ে লাইনের পাশে বসে পড়েছেন। কবিরাজের দরজায় আলম নামে এক যুবক পাহারা দিচ্ছেন। মহিলারা একে একে কবিরাজের কাছে যাচ্ছেন আর ২/৩ মিনিট পর পানি পড়া নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। আলমের মতো এখানে ১৫/২০ জন যুবক বাহির থেকে আসা মানুষদের নিয়ন্ত্রন করছেন। আর পানি পড়া দিতে গিয়ে কিছু সময় পর পর তার আসন ছেড়ে বাহিরে গিয়ে খেলাধুলা ও দোকান থেকে জিনিস কিনে খেতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, দুই সন্তান নিয়ে অন্যের জমিতে টিনের কুঠির ঘর তৈরি করে বসবাস করে আছেন দেলেয়ারা বেগম। স্বামী তাদের ছেড়ে অনেক আগে চলে গেছেন। বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন আর কাজ করতে হয় না। গ্রামের সমসের আলী হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে কবিরাজ দিপু। তবে কুরআন পড়া এখনো শুরু হয়নি। দিপুর বয়স ৯ বছর হলেও ৬ বছর বয়স থেকে পানি পড়া দিয়ে আসছে। প্রতিবেশী জহুরুল ইসলামের বউয়ের দীর্ঘদিন থেকে কোন বাচ্চা হয়নি। তিন বছর আগে তার বউকে পানি পড়া দেয়া হলে গর্ভধারন করে এবং বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবারও একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। গত তিন দিন বছর থেকে এ কবিরাজি চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তখন তেমন ভীড় ছিলনা। এ বিষয়ে তেমন কোন প্রচার-প্রচারনা করা হয়নি। যাদের বাচ্চা হয়েছে এবং উপকৃত হয়েছেন তারাই মূলত এ প্রচার প্রচারনা করেছেন।
তবে গত তিনমাস থেকে কবিরাজ দিপুর কাছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া ও জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত নারী-পুরুষ আসছেন পানি পড়া নিতে। পড়া পানি একনজ নারী দিনে দুবার খেতে হয় এবং একজন পুরুষ পড়া মধু দিনে দুবার খেতে হয়। এছাড়া পড়া তেল একজন পুরুষ দিন দুবার শরীরে মাখতে হয়। একজন নারীকে ৩/৫ সপ্তাহ চিকিৎসা নিতে হয়। এরমধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়। অন্তঃসত্ত্বা হলে ডাক্তার দিয়ে কোন চিকিৎসা বা আল্ট্রাসোনো করানো যাবে না বলেও নিষেধ করা হয়। প্রতি শুক্রবার করে পানি পড়া দেয়া হয়ে থাকে। কবিরাজি চিকিৎসা নিতে খরচ হয় তাবিজ ১৩০ টাকা এবং কবিরাজি ফি ১০ টাকা। যাদের মনোবাসনা পূরন হয় তারা কবিরাজের বাড়িতে এসে খাসি জবাই করে উপস্থিত সবার মাঝে বিতরণ করেন। গত শুক্রবার ২৮টি খাসি জবাই করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
নওগাঁ সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের গত ২৩ বছরে তাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তান নাই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কবিরাজের বাড়িতে এসে স্ত্রী শাহিদা বেগম লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন ডাক্তার ও কবিরাজের কাছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চিকিৎসা নিয়েও কোন কাজ হয়নি। কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছি পানি পড়া নিতে। শুক্রবার বেলা ১০ টা পর্যন্ত তার স্ত্রী সামনে আরো ৩০ জন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল।
রাজশাহীর পুটিয়া থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষিকা বলেন, বৃহস্পতিবার তার মাকে কবিরাজের বাড়িতে পাঠিছেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তিনি কবিরাজের বাড়িতে এসে প্রায় দেড়শ জনের পিছনে জায়গা পেয়েছেন। দাম্পত্য জীবনে গত ১০ বছর হলো কোন সন্তান হয়নি। পানি পড়ার বিষয়টি জানতে পেরে মনের বিশ্বাস নিয়ে এসেছেন।
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর গ্রামের ইমন হোসেন বলেন, সংসার জীবনে ৭ বছরে কোন সন্তান হয়নি। এখানে ৬ সপ্তাহ পানি পড়া খেয়ে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা হয়েছে। তাই পরিবার সহ এখানে এসে খাসি জবাই করে মানত পূরন করলাম।
কবিরাজ দিপুর মা দেলেয়ারা বেগম বলেন, দিপু যখন পেটে তখন থেকেই অনেক কিছু উপলদ্ধি করতাম। জন্মের আড়াই মাস বয়সে এক রাতে বাচ্চা সাপের রুপ ধারন করে। এরপর অনেক ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানো হয়। কবিরাজ বাচ্চার গায়ে হাত দিলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আমাদের অসহায়ত্ব দেখেই নাকী বাচ্চার উপর জ্বীনের আছর পড়েছে। তখন কবিরাজরাই বলেন বাচ্চাটিকে আমাদের কিছুই করার নাই। যখন বাচ্চা শরীরে জ্বীনের ভর করে তখন কোন নিঃসন্তান দম্পতি থাকলে তাকে বাচ্চা জন্ম ধারনের ক্ষমতা দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। এছাড়া কেউ যদি কাউকে কুফরি করে সেটাও ভাল করা যাবে। এরপর ৬ বছর বয়স থেকে পানি পড়া দিয়ে আসছে। রোগী দেখতে দেখতে বাচ্চা যখন অস্বস্থি বোধ করে তখন একটু দেরী করে বাহির থেকে ঘুরে এসে আবার দেখা শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাতে ছেলের গায়ে যখন ভর করে (জ্বীন হাজির হয়) কুরআনের সবকিছু বলতে পারে।
দুবলহাটী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, মানুষ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা জানি না। তবে এটা ভূয়া ও মানুষের সাথে প্রত্যারনা। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুরদুরান্ত থেকে লোকজন আসছে। এটা নিয়ে এলাকায় একটা পক্ষ (গ্রুপিং) তৈরী হয়েছে। যে কোন সময় সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে। প্রশাসনকে এ বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হাই বলেন, ছদ্দবেশে ঘটনাস্থলে (বৃহস্পতিবার) পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। এ রকম চিকিৎসা বন্ধ করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
নওগাঁ সিভিল সার্জন ডা: মুমিনুল হক বলেন, মেডিকেল সাইন্সে বন্ধা কোন নারী পানি পড়া খেয়ে পেটে বাচ্চা আসে এরকম কোন নিয়ম নাই। এছাড়া সাইনটিফিক (বৈজ্ঞানিক) এরকম কোন বিধানও নেই। যেখানে পানি, মধু পড়া এবং তেল পড়া ব্যবহার করলে পেটে বাচ্চা আসে। যদি এরকম কোন ঘটনা হয়ে থাকে আমরা সরজমিনে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.