গণহত্যায় নওগাঁ
১৯ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হতে যাচ্ছে
নওগাঁ প্রতিনিধি : মুক্তযুদ্ধ চলাকালে সারা দেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দেয়। নির্মম সেই সব গণহত্যার সাক্ষী পুরো দেশ। ১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ। সংগঠনটির কর্মীরা এ পর্যন্ত নথিবদ্ধ করেছেন জেলার ৬৭টি গণহত্যার বিবরণ।
একুশে পরিষদের কর্মীদের নিজস্ব অনুসন্ধানে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত আর ভাষ্য নিয়ে 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ' শিরোনামে একটি গ্রন্থের সম্পাদনার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী ১৯ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে বলে জানান, একুশে পরিষদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুর রউফ পাভেল।
আব্দুর রউফ পাভেল বলেন, একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। নয় মাসের যুদ্ধে পুরো বাংলাদেশ ছিল যেন বধ্যভূমি। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা নিরস্ত্র বাঙালিকে যেখানে-যেভাবে পেরেছে হত্যা করেছে। কোথাও কি লেখা হয়েছে সেই শহীদদের নাম, তাঁদের আত্মত্যাগের বিবরণ নিঃসন্দেহে, কাজটা বেশ কষ্টসাধ্য। ২০১০ সালে প্রায় অসম্ভব সেই কাজটাতেই হাত দেয় একুশে পরিষদ নওগাঁর কর্মীরা। দীর্ঘ ৯ বছর কাজ চলে তথ্য সংগ্রহের। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ঝাপসা হয়ে আসা বা ঝাপসা করে দেওয়া অধ্যায়গুলোকে একে একে একুশে পরিষদ তুলে ধরছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
সংগঠনের সভাপতি ডিএম আবদুল বারী বলেন, নওগাঁয় এখন পর্যন্ত ৬৭টি বধ্যভূমি বা গণহত্যার স্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করেই কাজ শেষ করছে না একুশে পরিষদ গণহত্যার তারিখে ওই স্থানে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আলোচনা, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে একুশে পরিষদ স্থানটিকে এলাকাবাসী এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন বাঙালির সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস। গৌরবজ্জ্বল সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গণকবর। মুক্তিযুদ্ধে সময় সংগঠিত গণহত্যার অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনও চিহ্নিত হয়নি। তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা থেকেই ২০১০ সাল থেকে একুশে পরিষদ নওগাঁর জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন গণকবরগুলো চিহ্নিত করা এবং ওই সব স্থানে গণহত্যা দিবস পালনের কাজ শুরু করে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ'র সম্পাদক মেহমুদ মোস্তফা রাসেল বলেন, বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের কাজটি করতে হয়েছে। প্রথমত ১৯৭১-এর ঘটনার সাক্ষী ছিলেন যাঁরা তাঁদের অনেকেই আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন সময়ের প্রবাহে ও বয়সের ভারে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। দ্বিতীয়ত অনেকেই ইচ্ছা করে বা অজ্ঞতায় ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। যেমন নওগাঁর পতœীতলার হালিমনগর গণহত্যার কথাই যদি ধরি ২০০১ সালের দিকে পতœীতলার স্থানীয় সংবাদিকদের লেখালেখির সূত্র ধরে আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। এ সময় কিছু লোক আমাদের জানায়, এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আমরা ফিরে আসি। অবশেষে ২০১১ সালে আমরা খুঁজে পাই সেই গণহত্যার ঘটনায় আহত গুলু মুর্মুকে। তাঁর সূত্র ধরে দেখা মেলে ওখানে যাঁদেরকে দিয়ে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল সেই আমিনুল, সাইফুলকে। তাদের বর্ণনায় ১৯৭১ সালে পতœীতলার নির্মইল ইউনিয়নের হালিমনগর গ্রামে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তাতে ২০ জন আদিবাসীসহ অন্তত ৫০ জন শহীদ হন। ২০ জন আদিবাসীর পরিচয় উদ্ধার করা গেলেও বাকিদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি, কারণ তাঁরা ছিল ভিন্ন স্থান থেকে ধান কাটতে আসা মানুষ এবং সাঁওতালপল্লীতে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা। এমনি করে একুশে পরিষদ নওগাঁর কর্মীরা নথিবদ্ধ করেছেন জেলার ৬৭টি গণহত্যার বিবরণ। এসব তথ্য-উপাত্ত আর ভাষ্য নিয়ে 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ' শিরোনামে একটি গ্রন্থ একুশে পরিষদ প্রকাশ করতে যাচ্ছে আগামী ১৯ এপ্রিল। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।
একুশে পরিষদের সংগঠনিক সম্পাদক বিষনু কুমার দেবনাথ বলেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর যাত্রা শুরু করে ১৯৯৪ সালে। নওগাঁর কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা, ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বেশ কিছু মানুষ মিলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় একটি সংগঠন। তখন সেই সংগঠনের নাম হয় ‘একুশে উদযাপন পরিষদ’। পরে মূলত কাজের ব্যাপ্তির দিকে লক্ষ্য রেখে সবার মতামতের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে নামকরণ করা হয় 'একুশে পরিষদ নওগাঁ।'
একুশে পরিষদের স: সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন লিটন বলেন, এই গ্রন্থে উঠে আসছে নওগাঁ সদরের ধামকুড়ি, পার-নওগাঁ মধ্যপাড়া, পার-নওগাঁ, মোহনপুর, দোগাছি, পার- বোয়ালিয়া, খাগরকুড়ি, নওগাঁ স্টেডিয়ামপাড়া, শেখপুরা, ফতেপুর গড়েরহাট, খাস-নওগাঁ, বলিহার চকদেব পাড়া, আরজি-নওগাঁ, হাট-নওগাঁ; মহাদেবপুর উপজেলার দেবীপুর, মহিষবাথান, মহাদেবপুর, নদীর পূর্বপাড়, আখেরা ও সিদ্দিকপুর, বাজিতপুর ও চকদৌলত; বদলগাছি উপজেলার কোলাহাট, ঐতিহাসিক পাহাড়পুর, ডাঙ্গিসার, গয়েশপুর, সেনপাড়া, লাবণ্য প্রভা; মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া, কবুলপুর, দেলুয়াবাড়ি-কিত্তলী, মনোহরপুর; পতœীতলার হালিমনগর, মধইল গণহত্যা, আমন্ত, গগনপুর, দুর্গাপুর (জঙ্গলপাড়া), নজিপুরচর, মোবারকপুর; আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া, মহাদীঘি, জালুপোঁতা-কচুয়া, পাইকড়া, সিংসাড়া, মিরাপুর, বেড়াহাসন, শিমুলিয়া, বান্দাইখাড়া, বাউল্লাহ, তারানগর, গোয়ালবাড়ি, বৈঠাখালী; রাণীনগর উপজেলার বড়বড়িয়া, আতাইকুলা, হরিপুর (রানী ভবানী জঙ্গল); ধামইরহাট উপজেলার কুলফতপুর, পাগল দেওয়ান, ফার্সিপাড়া; নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা, কারালিপাড়া (সোনারপাড়া); সাপাহার উপজেলার সাপাহার, কুচিন্দা, আশড়ন্দ, কল্যাণপুর, আইহাই, রসুলপুর সীমান্ত, পাহাড়িপুকুর; পোরশা উপজেলার শিশার গণহত্যার ঘটনাবলি।
একুশে পরিষদ এই প্রয়াস সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হারুল-অল-রশিদ বলেন, একুশে পরিষদ যে কাজ করছে নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গণকবরগুলো শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও অনেক গণকবরই সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব।