তন্ময় ভৌমিক, নওগাঁ : নিরাপদ আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় খাদ্য অভাবে কমছে জীব-বৈচিত্রের সংখ্যা। বন্যকুলের নিরীহ ছোট প্রাণী পাখিদের অনেক সময় এক শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন ভাবে কেনা-বেচা, হত্যা ও বিরক্ত করে। পাখি ও বন্য পশুদের হত্যা করায় সারাদেশ অনেক পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। দেশে কমে যাওয়া পাখিগুলো দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। এ ছাড়া পাখি ও প্রাণিদের বিরক্ত করায় দেশ থেকে ভয়ে চলে যাচ্ছে।
পাখি ও পশুদের নিরাপদ বাসস্থান ও সাধারন মানুষদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে নওগাঁ জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে গত কয়েক মাস আগে জেলার ১১টি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ভ‚মি অফিসসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপদ ‘অভয়াশ্রম’ বাসস্থান গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। ইত্যে মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে দেড়শ’ থেকে পাঁচশ’ মাটিত পাতিল টাঙ্গানো হয়েছে। এতে পাখিরা তাদের নিরাপদ বাসস্থান পেয়েছে। এ উদ্যোগ মানুষদের মাঝে ব্যাপক সারা ফেলেছে। জেলা প্রশাসকের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সচেতনরা। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে এক সময় নওগাঁয় দেশী পাখি সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে নিরাপদ আশ্রয় পেলে বিভিন্ন অতিথি পাখির আসা যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ।
এ ছাড়া ইত্যে পূর্ব থেকে জেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে স্থানীয় জনসাধারণ সংগঠনের মাধ্যমে পাখিদের অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন।
স্থানীয় ও প্রাণিবিদ জানান, প্রকৃতিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ সবারই মন কাড়ে। পাখিরা বিশেষ করে গাছে আশ্রয় নিয়ে থাকে। গাছেই তাদের ঘর সংসার। সেখানে তাদের ডিম ও বাচ্চা ফুটানো। আর তাদের সুখের সংসারে আঘাত হানে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। গাছে আশ্রিত পাখিদের বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়ে থাকে। এতে তাদের ডিম ভেঙে যায়। আবার বাসায় থাকা ছানা নিচে পড়ে মারা যায়। অনেক পাখি ঝড়ের কবলে পড়ে ডানা ভেঙে যায় এবং মারাও যায়। এতে পাখিরা নিরাপদ আশ্রয় না ভেবে অন্যত্র দলবেঁধে চলে যায়। এ সব পাখিদের বাঁচাতে সরকারি রাস্তাঘাট ও জায়গায় বেশি করে ‘ফলজও’ গাছ লাগানোর দাবি জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এসব দিকে বিবেচনা করে পাখীদের নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়তে উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা প্রশাসক। গত কয়েক মাস থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে বড় বড় গাছে মাটির হাড়ি (পাতিল) বেঁধে দেয়া হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনায় উপজেলা পর্যায়ে ইউনিয়ন ভ‚মি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এ কাজে সহযোগীতা করা হচ্ছে।
বদলগাছী উপজেলার পশ্চিম বালুভরা গ্রামের প্রায় তিনশ’ বছরের বট গাছ। জায়গাটি ছায়া শীতল স্থান হওয়ায় সেখানে অনেক প্রজাতির পাখির আনাগোনা। তাই ওই স্থানটিকে পাখিদের জন্য একটি অভয়াশ্রম করতে গাছের ডালে পাতিল বেধে বাসস্থান করা হচ্ছে। পাতিলগুলোর একপাশে ছিদ্র যুক্ত। দুটি ডালের মাঝখানে এমন ভাবে কায়দা করে পাতিলগুলো বসানো হয়েছে যেন বৃষ্টির পানি ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।
এসব পাতিলের মধ্যে নিরীহ প্রাণী পাখিরা দিনে ও রাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। গাছে পাতিল বেঁধে দেয়ায় নিরাপদ মনে করে বাসা বেঁধেছে দোয়েল, ঘুঘু, শালিক বাবুই ও বুলবুলিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এমনকি কাঠ বিড়ালীও। গাছের ডালে ডালে প্রায় ৫০টির মতো মাটির পাতিল বেঁধে দেয়া হয়েছে।
বদলগাছী উপজেলার পাটনঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিলি ফরাহানা বলেন, পাখিরা মূলত গাছে আশ্রয় নিয়ে থাকে। বছরে বেশ কয়েকবার ঝড় হয়। এতে পাখিদের ডিম ভেঙে ও বাচ্চা নিচে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঝড়ঝাপটায় অনেক পাখির ডানা ভেঙে যায়। পাখীরা যেন ভাল থাকে তার জন্য জেলা প্রশাসক স্যার বট গাছে পাতিল টাঙিয়ে দিয়ে পাখিদের নিরাপদের ব্যবস্থা করেছেন যা নি:সন্দেহ একটি ভাল উদ্যোগ।
উপজেলার বালুভরা-বিলাশবাড়ী ইউনিয়ন ভ‚মি অফিস সহকারী কর্মকর্তা মওদুদুর রহমান কল্লোল বলেন, হাট-বাজারে বড় বড় গাছে পাতিল টাঙানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক পাতিল টাঙানো হয়েছে। নিরাপদ মনে করে পাখিরা আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। কাঠ-বিড়ালীও পাতিলের মধ্যে বাসা বেঁধেছে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সাধারন সম্পাদক ও সাংবাদিক ইউনিয়ন, নওগাঁ আহবায়ক অ্যাডভোটেক শহীদ হাসান সিদ্দিকী স্বপন জানান, ইত্যে মধ্যে জেলার বিভিন্ন স্থানে গাছে গাছে মাটির পাতিল টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব পাতিলে পাখি বসবাস শুরু করেছে। জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের এই উদ্যোগ প্রসংশনীয়। এই ভালো উদ্যোগকে সফল করার সাথে পাখি হত্যা বন্ধে শুধু প্রশাসনিক কর্মকর্তা নয়; নওগাঁবাসিদের এগিয়ে আসতে হবে।
রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন জানান, সবে মাত্র যোগদান করেছি। জেলা প্রশাসক স্যারের এই মহৎ কাজকে এগিয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুম আলী বেগ বলেন, পশু পাখি পরিবেশের একটা অংশ। পাখিদের নিরাপদ আবাস গড়তে জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে হাট-বাজারে সরকারি গাছগুলোতে মাটির ছোট পাতিল বেঁধে দেয়া হচ্ছে। উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর প্রাণিবিদ শরিফুল ইসলাম জানান, এই উদ্যোগকে সফল করতে প্রথমত, পাখি হত্যা বন্ধ করতে কার্যকরি প্রদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারি জায়গায় ও অফিস চত্ত¡রে বেশি করে ফলজও গাছ লাগাতে হবে। এই ফলজও গাছ থেকে পাখি তাদের খাবার খেয়ে ওই সকল বাসস্থানে নিরাপদে বসবাস করবে। তিনি আরো জানান, পাখি কৃষি ‘বন্ধু’। প্রতিটি পাখি ফলের পাশাপাশি পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। একটি পাখি হত্যা মানে ওই পাখি সমপরিমাণ পোকার বৃদ্ধি করা।
জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, পাখিরা যেন নিরাপদে থাকতে পারে। পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়তে এমন পরিকল্পনা। জীব ও বৈচিত্র সংরক্ষণে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, ভ‚মি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি, বে-সরকারি কর্তকর্তা ও গণ্যমান্যদের নিয়ে আলোচনা সভাও করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রতি উপজেলায় পরিষদ চত্ত¡র, ভূমি অফিস চত্ত¡র ও নিবিড় স্থানগুলোতে পাখিদের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি করা হচ্ছে। আগামিতে অফিস চত্ত¡রে ফলজও গাছ লাগানো সাথে জনসাধারণদের সাথে আলোচনা সভা ও র্যালীর মধ্যে দিয়ে সচেতনতা করা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন