তন্ময় ভৌমিক, নওগাঁ: ঠাঠা বরেন্দ্র ভূমিতে পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, বদলগাছী, ধামইরহাট, নওগাঁ সদরসহ নওগাঁয় মাল্টা চাষে ঝুঁকছে পরেছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত দুই বছরে প্রায় একশ’ বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে উঠেছে। এ দিকে মাল্টা চাষি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। মাল্টা চাষে লাভ হলে আগামিতে ঠাঠা বরেন্দ্র ভূমিতে মাল্টা চাষের বিপ্লব হবে এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বদলগাছী হর্টিকালচার সূত্রে জানিয়ে, অন্যান্য ফসলের চেয়ে কম চাহিদা সম্পন্ন মাল্টা চাষে বিপ্লব ঘটানো ও বিদেশ থেকে আমদানির চাপ কমাতে হর্টিকালচারে ২০১৫ সাল থেকে বারি-১ জাতের মাল্টার গাছ তৈরী শুরু হয়। ইত্যে তিন হাজার বিক্রি করা হয়েছে। হর্টিকালচারে সহযোগিতায় জেলায় গত তিন বছরে একশ’টি মাল্টার প্রদর্শণীয় প্লট তৈরী করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পানির স্তর নীচে হওয়ায় বর্ষ মৌসুমে ধানের আবাদ ছাড়া তেমন কোন ফসল চাষ হয় না ঠাঠা বরেন্দ্র ভূমি পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, বদলগাছী উপজেলায়। বছরের অধিকাংশ সময় পতিত থাকা জমিতে কৃষকরা গড়ে তোলেন আম বাগান। আমে অনেক সময় লোকসান হওয়ায় আমের পরিবর্তে অন্যান্যে ফসল চাষের চিন্তা শুরু করেন কৃষকরা। এমতাবস্তায় টেলিভিশনে মাল্টা চাষের প্রতিবেদন দেখে দেড় বছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাল্টা চাষ শুরু করেছেন কৃষকরা।
পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের ওবাইদুল্লাহ শাহ জানান, আম বাগানের পাশাপাশি বারি-১ জাতের ৬শ’টি মাল্টা গাছ লাগান। ৬শ’টি গাছের মধ্যে ২শ’টি গাছে মাল্টা ধরেছে। ২শ’টি গাছে প্রায় ৩০ থেকে ৭০টি করে মাল্টা ধরেছে। মাল্টা বিক্রি করে ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন মাল্টা চাষি।
পোরশা উপজেলার ছাউল গ্রামের আবু বক্কর মন্ডল জানান, দুই বছর আগে মাল্টা চাষে করতে প্রথমে মাটি খনন করে বিভিন্ন সার মিশ্রণ করে এক মাস রেখে দেয়ার পর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আম বাগানের মধ্যে ৭শ’ টি চারা আমের বাগানে এনে লাগান। এর মধ্যে ভিয়েতনাম দেশের ৫শ’ এবং বাঁকি ২শ’টি বারি-১ জাতের মাল্টা ফলের গাছ লাগান। প্রায় ৪শ’টি মাল্টা গাছে মাল্টা ধরেছে। বারি-১ জাতের চেয়ে ভিয়েতনাম দেশের মাল্টার ফল তুলনামূলক বড় এবং মিষ্টি। গত কয়েক মাস আগে মাল্টা গাছের পাতা পচে কুঁকড়ে মরে যাচ্ছিল। কৃষি বিভাগকে জানালে তারা পাতা নিয়ে যায়। এরপর তারা কোন প্রতিকার দেয়নি বা কোন সহযোগিতা করেনি। এতে হতাশা দেখা দিয়েছিল। স্থানীয় ভাবে পরিচর্যা করে উপকার পেয়েছেন। মাল্টা চাষে লাভজনক হলে আম বাগান কেটে ফেলবেন এমনটাই জানালেন এই মাল্টা চাষি।
ছাউল গ্রামের আশরাফ আলী মন্ডল জানান, এলাকার অনেকেই মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হলেও মাল্টা চাষিদের মাল্টা গাছে রোগবালাই দেখা দেয়া। কৃষি বিভাগ থেকে তেমন সহযোগিতা না পাওয়া স্থানীয়ভাবেই নিম গাছের রস দিয়ে রোগবালাই দমন করা হয়েছে। মাল্টা চাষে দেখে অনেকেই পরামর্শ নেয়ার পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
সাপাহার উপজেলা সদরের সোহেল রানা। তার বাগান পতœীতলা উপজেলার রূপগ্রামে তার বাগানে বদলগাছী হর্টিকালচার থেকে দুই বছর আগে ২০টি মাল্টা পান। এরপর সিলেট থেকে আরো ৬০টি মাল্টা এনে লাগান। গাছগুলোর মধ্যে ৪২টি গাছে ৩০ থেকে ৪৫টা পর্যন্ত মাল্টা ধরেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময় তাকে পরামর্শ দেয়া গাছগুলো বেশ ভালো হয়েছে।
পতœীতলা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা প্রকাশ কুমার জানান, সোহেল রানাকে সব সময় সহযোগিতা করা হচ্ছে। সোহেল রানার মতো অনেক যুবক মাল্টা চাষে পরামর্শ নিয়ে যাচ্ছেন। গত দেড় বছরের মধ্যে উপজেলায় প্রায় ২৫টি মাল্টার প্রদর্শনীয় প্লট গড়ে তোলা হয়েছে।
পোরশা উপজেলার উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, বরেন্দ্রভ‚মির এসব জমিতে বর্ষাকালে শুধু মাত্র আমন ধান চাষ করা হতো। আমন ধানের চেয়ে আম চাষে লাভবান হওয়ায় কৃষকরা ঝুঁকে পরেছেন। আম চাষের চেয়ে মাল্টা চাষে ঝুঁকি কম এবং কম সেচ লাগে এ জন্যেই কৃষকদের মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আলম জানান, কৃষি বিভাগ থেকে দেড় বছর আগে উপজেলায় কৃষদের মাঝে মাল্টার ২০টি প্রদশনীয় প্লট তৈরী করা হয়। ওই প্রদর্শনীয় প্লট দেখে এলাকার অনেক কৃষক মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। গত দেড় বছরে উপজেলায় ৫০ বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে উঠেছে। আগামীতে মাল্টা চাষে কৃষকদের আরো উদ্বুদ্ধ করা হবে।
মাল্টা চাষিরা কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ না পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে মাহফুজ আলম বলেন, কৃষি বিভাগে জনবল সংকট থাকায় হয়তো অনেক সময় শতভাগ সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে চাহিদা মোতাবেক জনবল থাকলে শতভাগ সেবা দেয়া সম্ভবের আশার কথা শুনালেন।
বদলগাছী হর্টিকালচারে সিনিয়র উদ্যানতত্ত¡ বিদ আ.ন.ম. আনারুল হাসান জানান, মাল্টা চাষে বিপ্লব ঘটানো ও বিদেশ থেকে আমদানির চাপ কমাতে মাল্টা-১ জাতের তিন হাজার গাছ বিক্রি করা হয়েছে। জেলায় গত তিন বছরে একশ’টি মাল্টার প্রদর্শণীয় প্লট তৈরী করা হয়েছে। প্রতি প্লটে মাল্টার গাছ লাগানো হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫টি। প্রায় ৯৫টিই গাছই বেঁচে রয়েছে। জেলার মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা মাল্টা-১ জাতের ফল মিষ্টি। টক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি আরো জানান, জেলায় মাল্টা চাষের বিপ্লব ঘটানো পরিকল্পনা রয়েছে। একারণেই হর্টিকালচার কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি মাল্টা বিক্রি হয় বিশ টাকা থেকে পঁচিশ টাকায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক জানান, পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, বদলগাছী, ধামইরহাট ঠাঠা বরেন্দ্র ভ‚মি হিসেবে পরিচিত। এই উপজেলাগুলোর মধ্যে পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুরের অধিকাংশ জমিতে আমন ধান ছাড়া অন্য কোন ফসল উৎপাদন হয় না। এ কারণে আম বাগান গড়ে তুলছেন। কম পানি চাহিদা সম্পন্ন মাল্টা চাষে বর্তমানে জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে বিশেষ করে পোরশা, সাপাহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। ইত্যে মধ্যে জেলায় একশ’ বিঘারও উপর জমিতে মাল্টা চাষ করা হয়েছে।
নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম জানান, তার গ্রামের বাড়ি চেরাগপুর গ্রাম এক বিঘার জমির উপর অন্যান্যে ফলের পাশাপাশি একশ’টি মাল্টার গাছ দেড় বছর আগে লাগান। ইত্যে মধ্যে প্রায় ৭০টি গাছে মাল্টা ধরেছে। এলাকার অনেক লোকই মাল্টার বাগান দেখেতে আসেন। সাংসদ আরো আশা ব্যক্ত করেন, আগামিতে মাল্টা চাষে নওগাঁ জেলা দেশে একটি রোল মডেল হবে। এ জন্যে মাল্টা চাষে কৃষি বিভাগের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে।
জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান জানান, মাল্টা চাষ জেলায় অপারসম্ভাময় থাকায় কৃষি বিভাগকে মাল্টা চাষিদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত বছর দুইয়ের মধ্যে যে ভাবে মাল্টা চাষ করা শুরু হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে মাল্টা চাষে নওগাঁয় বিপ্লব ঘটানো যাবে। এতে বিদেশ থেকে মাল্টা আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন