রহমতের সওগাত পবিত্র রমজান

অপেক্ষা ও আকাঙ্ক্ষার প্রহর পেরিয়ে পবিত্র রমজান আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। সুস্বাগত মাহে রমজান। ইবাদতের মাস ‘রহমতের সওগাত’ রমজান, হাদিসের ভাষায় ‘শাহরুন আজিম’, ‘শাহরুম মুবারাকাহ’। রমজান মাসের বিশেষ চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। (ক) এ মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে, (খ) এ মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’, (গ) এ মাসে শয়তান বন্দি থাকে, (ঘ) এ মাস মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমায় সমুজ্জ্বল।


রমজান মানুষের আত্মোপলব্ধি জাগ্রত করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘উঠুক তুফান পাপ-দরিয়ায়’ কবিতায় এমনই অনুরণন ধ্বনিত হয়েছে : ‘উঠুক তুফান পাপ-দরিয়ায়/আমি কি তায় ভয় করি।/পাক্কা ঈমানের তক্তা দিয়ে গড়া যে আমার তরী।/লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর পাল তুলে/ঘোর তুফানকে জয় করে ভাই যাবই কূলে,/আমার মোহাম্মদ মোস্তফা নামের গুণের রশি ধরি।/খোদার রাহে সঁপে দেওয়া ডুববে না মোর এ তরী,/সওদা করে ভিড়বে তীরে সওয়াব-মানিক ভরি।/দাঁড় এ তরীর নামাজ রোজা হজ ও যাকাত,/উঠুক না মেঘ, আসুক বিপদ—যত বজ্রপাত,/আমি যাব বেহেশত-বন্দরেতে এই সে কিশতীতে চড়ি।’


রমজানের সব মুহূর্ত মহাপ্রভুর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা মুমিন বান্দার একমাত্র কর্তব্য। এ মাসের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, পরিশীলন ও অধ্যাত্ম জাগরণে মানুষ প্রমাণ রাখে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহান স্রষ্টার ‘প্রতিনিধিত্বে’র যোগ্যতার। কেননা এ মাসে ঘোষণা করা হয়—‘হে ভালোর অন্বেষী অগ্রসর হও, মন্দের অন্বেষী থামো।’ (তিরমিজি)


বিস্ময়কর সম্মোহনী শক্তি নিয়ে পবিত্র রমজানে আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে যে ‘আল কোরআনের সতর্কবাণী অবলোকন ও অনুধাবন করলে সুকঠিন মানবাত্মাও প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। কোরআনের আশ্বাসবাণী অনুধাবন করে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, রুদ্ধ কর্ণকুহর প্রত্যাশার পদধ্বনি শুনতে পায়। আর মৃত অন্তরাত্মা ইসলামের অমীয় সুধা পানের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এসব মিলে হৃদয়রূপ বেতারযন্ত্রে বেজে ওঠে ঐশী প্রেমের মন মাতানো সুমধুর সুরলহরি।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির প্রথম খণ্ড : ই. ফা. বা)


রমজানে আকুল-ব্যাকুল হয়ে পাপমোচন এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও ইবাদতের কল্যাণে পরিশুদ্ধ হয় সবাই। এভাবেই মানুষের মধ্যে ‘তাকওয়া’ বা ধর্মভীরুতা সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহ বলেন ‘…লা-আল্লাকুম্ তাত্তাকুন’। That ye (you) may (learn) self-restraint. অর্থাৎ যেন তোমরা ধর্মভীরুতা অর্জন করতে পারো। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)


অনাচার, অসভ্য, অসত্যের নিকষ অন্ধকারের অবসান ঘটাতে মহাসত্যের চিরন্তন জ্যোতিষ্ক মহাগ্রন্থ আল কোরআন পবিত্র রমজানের শ্রেষ্ঠতম রজনী ‘লাইলাতুল কদরে’ নাজিল হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মহিমান্বিত রমজান মাস, এতে মানবজাতির পথপ্রদর্শক এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)


‘রমজ’ শব্দমূল থেকে বিকশিত ‘রমজান’ দহন, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিখাদ-নিষ্কলুষ ও বক্রতা-বিকৃতিমুক্ত খাঁটি, পবিত্রকরণের মূলগত ও তাৎপর্যগত অর্থ বহন করে। ইসলামের অনন্য স্তম্ভ ‘সাওমে’র বহুবচন ‘সিয়াম’ অর্থ বিরত থাকা, বর্জন করা ইত্যাদি। এর ফারসিরূপ ‘রোজা’। সিয়াম হলো পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিমুক্ত হওয়া। খাদ্যাভ্যাসে কৃচ্ছ্রের মাধ্যমে রোজা মানুষের জৈবিক লালসা নিবৃত্ত করে। ফলে এক অধ্যাত্ম আবেগ-অনুভূতি জেগে ওঠে। এভাবেই বান্দা আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মহিমায় সারা বছর পরিশীলিত জীবনবোধের যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) ‘আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে’ গ্রন্থে রোজার কয়েকটি উপকারিতা বর্ণনা করেন : (১) রোজা দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আকলের (জ্ঞান) পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, (২) অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়, (৩) স্বভাবে বিনয়-নম্রতা সৃষ্টি করে, (৪) মানুষ ফেরেশতা চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, (৫) মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে।


অন্যদিকে ধর্মভীরুতা দ্বারা মুমিন বান্দা ‘সিফাতে রব্বানি’ বা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়, তার মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা জেগে ওঠে। আর রোজা পালন করা আল্লাহর প্রতি গভীর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন। কেননা কারো প্রতি মহব্বত জন্মিলে, তাকে লাভ করার জন্য প্রয়োজনে প্রেমিক পানাহার বর্জন করে এবং সব কিছু ভুলে যায়। ঠিক তেমনিভাবে রোজাদারও আল্লাহর মহব্বতে দেওয়ানা হয়ে সব কিছু ছেড়ে দেয়। এমনকি পানাহার পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই রোজা হলো আল্লাহর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন।’ (ফতওয়া আলমগীরী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২)


রমজানে মানুষ আত্মসংযমের মাধ্যমে নিজেকে মহান আল্লাহর খাঁটি বান্দা হিসেবে গড়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। রমজানে মুমিন বান্দার সব তৎপরতা উচ্চ মর্যাদার ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। রমজানে সিয়াম সাধনার তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের জন্য রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে…।’ সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতের মূল পাঠ—‘কুতিবা আলাইকুম…..’ এর ইংরেজি Fasting is prescribed to you এমন বক্তব্য প্রমাণ করে রোজার মহিমা, এ তো মহাপ্রভুর লিখিত বা prescribed আদেশ এবং তা অবশ্য পালনীয়। কেননা আরবি ‘কুতিবা’ শব্দের বাংলারূপ ‘লিখে দেওয়া হলো’। আর সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ‘তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পায়…’ এর ইংরেজি Who is present during that month should spend it in fasting. এতেই বোঝা যায়, এ মাসের সব ইবাদতের মূল্য কত বেশি। আর prescribed, present, should, self-restraint ইত্যাদি শব্দ বক্তব্যের গাম্ভীর্য ও গভীরতা প্রমাণ করে।


অন্যদিকে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা’ গ্রন্থে আছে—‘প্রাচীন মিসরীয় ধর্ম, এমনকি গ্রিক ও পারসিক ধর্মে উপবাস প্রথা প্রচলিত ছিল…; পৃথিবীর এমন কোনো ধর্মমত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাতে উপবাসরীতির প্রচলন নেই।’ কেননা ‘ভোজনে কৃচ্ছ্রসাধন’ আবহমান ঐতিহ্যে সব ধর্মে স্বীকৃত। অথচ আমরা বাস্তবতায় দেখি—‘রোজায় বাড়ে ভূরিভোজ/‘দিনকে রাত করে’ চলে—/সব খাবারের মৌজ।/‘জীবনে যাদের হররোজা’।/আমরা রাখি না তাদের খোঁজ।/স্বয়ং ‘যম’ পাল্টে দেয়,/সংযমের সাজগোজ। শয়তানিতে নাচায় মানুষ—‘বন্দি শয়তান’ সারা রোজ।। (স্বরচিত)।

লেবেলসমূহ:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger][facebook]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

আজকের দেশ সংবাদ . Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget